‘একদিন লাল-সবুজ পতাকাও যাবে মঙ্গলে’

না, নভোচারী হিসেবে হয়ত নয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের তৈরি রোবট যেতে পারে লাল গ্রহে আর সঙ্গে থাকতে পারে লাল-সবুজের স্মারক –এমনই আশার বাণী শোনালেন বাংলাদেশি রোবট নির্মাতারা।

তাহমিন আয়শা মুর্শেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2016, 04:38 PM
Updated : 30 June 2016, 04:50 PM

মঙ্গলে মানববসতি স্থাপন নিয়ে গবেষণায় মহাকাশ গবেষকদের প্রচেষ্টা এখন আলোচনার তুঙ্গে। এমন সময় মঙ্গল গবেষণায় রোবটের কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্টভিত্তিক মঙ্গল গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্স সোসাইটি আয়োজন করে এক রোবট প্রতিযোগিতার। পৃথিবীর মঙ্গলের মঙ্গলের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন বিষয় মাথায় রেখে বেছে নেওয়া হয় স্থান, আর রোবটগুলোকে দেওয়া হয় নানা কাজ। সারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অংশ নেওয়া দলগুলো ছবিতে চোখে পড়ে দুটি বাংলাদেশের পতাকাও।

আমেরিকার ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের ‘মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশন’-এ অনুষ্ঠিত হওয়া ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি)-এর এবার ছিল ১০ম আসর। এতে প্রাথমিকভাবে অংশ নেয় ১২টি দেশের ৬৩টি দল। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় সাতটি দেশের ৩০টি দলের প্রতিযোগিতা জমে উঠে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক বাছাইপর্ব শেষে ২ জুন শুরু হয় এই প্রতিযোগিতা। মঙ্গলের অসমতল পাহাড়ি-পাথুরে পথে চলতে 'সক্ষম' রোবট নিয়ে অংশ নেয় প্রতিযোগীরা। রোবটগুলো  শুধু মঙ্গলের প্রতিকূল পথে চলতে পারাই নয়, সেইসঙ্গে পথের বিভিন্ন উপাদান যোগাড় করতেও সক্ষম। তা ছাড়াও মহাকাশচারীকে সহযোগিতা যেমন, ক্রু আনা-নেওয়া বা সুইচ অন-অফ করাসহ মঙ্গলে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র মেরামতের কাজ করতেও পারে রোবটগুলো। প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ ৫০ কেজি ভরের রোবটগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কিছু কাজ সম্পন্ন করতে দেওয়া হয়, যার ভিত্তিতে বিবেচিত হয় হার-জিতের ফলাফল।

ইউআরসি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দলগুলো

প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পোল্যান্ডের একটি দল। ৫ম আর ৮ম স্থান দখল করে নিয়েছে যথাক্রমে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট)-এর ‘ইন্টারপ্লানেটার’ ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) -এর শিক্ষার্থীদের দল 'রোবটিক ক্রু'।

ইন্টারপ্লানেটার-এর নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েট শিক্ষার্থী খালেদ বিন মইনউদ্দীন আর আল আরাবির। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাদের দল ‘বুয়েট এক্সপোনেনশিয়াল’ ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল রোবোটিকস চ্যালেঞ্জ'-এ ২য় হয়েছিল।

১১ সদস্যের এই দলে আরও আছেন ফজলে এলাহী খান, ইরফান মোহাম্মদ আল হাসিব, আশরাফুল আলম, কুমার দীপায়ন তূর্য, নওয়াব মো. আমিনুল হক, শায়াক ইবনে ফারুকী, নবী বিন হোসাইন, সংকলন বড়ুয়া ও সাব্বির পারভেজ। প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে তারা সাত মাস যাবত কাজ করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারে 'পৃষ্ঠপোষকের অপ্রতুলতা' নিয়ে উঠে আসে তাদের ক্ষোভ। খালেদ বলেন, "১ম স্থান অধিকার করা পোল্যান্ডের দলটির বানানো রোবটের এক একটি অ্যান্টেনার দাম এমন, যা দিয়ে আমাদের ২ দলের ফ্লাইটের খরচ হয়ে যায়। সে তুলনায় অনেক কম খরচে তৈরি আমাদের রোবটের কার্যকারিতা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট।"

এআইইউবি-এর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান-এর নেতৃত্বে অংশ নেওয়া ১৭ সদস্যের এই দলে আরও রয়েছেন আশিক সরকার, আবির হোসেন, ফারহান মাহমুদ, চৌধুরী মিফতাহ্ মাহমুদ, নিসার সরকার, নাজিমউদ্দৌলা, সোহানুজ্জামান জিম, মিনার রহমান, কামরুল হাসান, এইচ এম আতা-ই-রাব্বি, শাবাব ইকবাল, সিফাত নুর আরপি, জিসান আহমেদ, শশাঙ্ক কুমার প্রামাণিক ও মিজানুর রহমান।

রোবটের সঙ্গে রোবটিক ক্রু

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথমবার অংশ নিয়ে সেরা আট-এ আসতে পেরে বেশ খুশি তারা। আড্ডায় মাহফুজ সেখানকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, তারা এবার প্রথমবার কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাওয়ায়, প্রথমে একটু অপ্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তারপর সেখানে গিয়ে তারা অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে মিশতে পেরে পরিবেশের সঙ্গে সহজ হয়ে উঠে।

তার সঙ্গে সুর মেলান আরাবিও। "প্রথমবার অংশগ্রহণ করলেও কোন দলের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ ছিল না। রোবটের প্রযুক্তি আর অন্যান্য বিষয়ে সবার খোলাখুলি আলোচনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে।"

আলোচনায় অংশ নেওয়া ইন্টারপ্লানেটার-এর আরেক সদস্য আরাবি বলেন, "উন্নত রোবট তৈরি করার মতো প্রতিভা আর উৎসাহ আছে নতুন অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের তুলে আনতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উপযুক্ত সহযোগিতা প্রয়োজন।"

পরবর্তী পরিকল্পনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে আরাবি জানান, পোল্যান্ড অনুষ্ঠিতব্য ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ (ইআরসি)-তে অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বাংলাদেশে একটি মার্স অ্যান্ড লুনার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করার আশাও প্রকাশ করেছেন তিনি।

ইন্টারপ্লানেটর ও তাদের রোবট

"মঙ্গলে ২০২৬ এর মধ্যে বসতি স্থাপন সম্ভব"- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রযুক্তি পাতায় চলমান এই জরিপ প্রসঙ্গেও মত দেন তারা। এক্ষেত্রে তাদের তিনজনের একই সুর ছিল। প্রযুক্তির অব্যাহত উন্নতিতে মঙ্গলে বসতি স্থাপন অবশ্যই সম্ভব বলেই তাদের বিশ্বাস। তবে, এক্ষেত্রে এত জলদি এমন কিছু করা যাবে কিনা তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে। সময়টা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, বিজ্ঞানের কল্যাণে এমনটা যে হতে যাচ্ছে, এমন ধারণায় জোর সমর্থন রয়েছে তাদের। 

তাদের মতে, এমন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহাকাশবিষয়ক শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের চিন্তা-ধারণা আদান-প্রদানে সাহায্য করছে। শত প্রতিকূলতার পরও ভবিষ্যতে এভাবেই হয়তো মঙ্গলে পৌছে যাবে বাংলাদেশের পতাকা এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করেন নবীন এই 'মহাকাশ বিজ্ঞানীরা'।