মহাকাশ প্রযুক্তি-তে বাংলাদেশের নতুন যাত্রা

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে প্রথমবারের মতো মহাশূন্যে নিজের চিহ্ন রাখতে চলেছে বাংলাদেশ। বার্ডস প্রজেক্টের আওতায় প্রথমবারের মতো দেশি ন্যানোস্যাটেলাইট বানানো থেকে শুরু করে তা থেকে ডেটা ডাউনলোড করার কাজ করবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।

শাহরিয়ার হাসান পরশবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2016, 03:17 PM
Updated : 23 June 2016, 03:44 PM

কিউব-সাইটেলাইটের উপরে ইতোমধ্যেই জাপানের কিউসু ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহিল কাফি, মাইসুন ইবনে মনোয়ার এবং রায়হানা শামস ইসলাম অন্তরা। দেশে গ্রাউন্ড স্টেশনের কাজ শুরু করেছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ সৌরভের নেতৃত্বে আরেকটি দল।

ন্যানোস্যাটেলাইটে বাংলাদেশের লাভ কী? এমন প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়-এর কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান-এর সঙ্গে কথা বলে। তার মতে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন এক সম্ভাবনার জগতে প্রবেশ করল। এটি কোনো বাণিজ্যিক প্রকল্প নয়, এটি একটি শিক্ষামূলক প্রকল্প। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মহাকাশ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানবে, শিখবে এবং এক সময় নিজেরাই বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ খাতে কাজ করবে, একেই দেশ ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ হিসেবে দেখছেন এই অধ্যাপক। এ ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ দেন, এক সময় বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন বা মোবাইল যোগাযোগ খাতে, যেখানে বিদেশীকর্মীদের উপর অনেক বেশি খরচ করতে হত, এখন অনেক জায়গায় দেশিয় ছেলেরা কাজের সুযোগ পাওয়ায় এ খরচ অপেক্ষাকৃত কম। ভবিষ্যতে মহাকাশ প্রযুক্তি খাতেও দেশের ছেলেদের এমন "গৌরবময় অংশগ্রহণের" স্বপ্ন দেখেন তিনি।

অন্বেষা ৩বি হাতে আব্দুল্লাহিল কাফি, ও রায়হানা শামস ইসলাম অন্তরা

বার্ডস প্রজেক্ট

দ্য জয়েন্ট গ্লোবাল মাল্টি-ন্যাশন বার্ডস স্যাটেলাইট প্রজেক্ট বা সংক্ষেপে বার্ডস প্রজেক্ট হচ্ছে কতগুলো দেশের সহযোগিতায় আন্তঃবিষয়ক স্যাটেলাইট প্রজেক্ট। মহাশূন্যে এখনো পৌঁছাতে পারেনি এমন কিছু দেশের সঙ্গে জাপানের সহযোগিতায় প্রজেক্টটি শুরু হয়েছে। জাপানে স্যাটেলাইট গবেষণার এই মহাযজ্ঞে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও কাজ করছে ঘানা, মঙ্গোলিয়া এবং নাইজেরিয়া। দেশগুলো থেকে আগত শিক্ষার্থীরা ডিজাইন থেকে শুরু করে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের কাজ করবে নিজেরাই। কাজ এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে কিউসু ইনস্টিটিউট টেকনোলজি'র চারজন ফ্যাকাল্টি সদস্য। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর তা থেকে ডেটা সংগ্রহের জন্য থাকবে সাতটি গ্রাউন্ড স্টেশন। গ্রাউন্ড স্টেশনগুলো অংশগ্রহণকারী পাঁচটি দেশসহ থাইল্যান্ড এবং তাইওয়ানে স্থাপিত হবে।

কিউবস্যাট

কিউবস্যাট আকৃতির দিক থেকে বেশ ছোট হয়। বার্ডস প্রজেক্টে কর্মরত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইসুন ইবনে মনোয়ার তার ব্যক্তিগত সাইটে কিউবস্যাট সম্পর্কে লিখেন, একটি স্যাটেলাইট যা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতায় ১০ সেন্টিমিটারের বড় নয় এবং ওজন ১ দশমিক ৩৩ কেজির কম তাকে কিউবস্যাট বলা হয়। কিউবস্যাটকে 'ওয়ানইউ'ও বলা হয়ে থাকে।

কিউবস্যাটের ধারণা প্রথম দেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর টুইগস। প্রথমে কেউ তেমন পাত্তা না দিলেও পরে বিশ্বব্যাপী কিউবস্যাটের ব্যবহার শুরু হয়। দিনদিন কিউবস্যাটের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশি গ্রাউন্ড স্টেশনের সদস্যরা

অন্বেষা ৩বি

বাংলাদেশের হয়ে যে কিউবস্যাটটি মহাশূন্যে যাবে তার নাম দেওয়া হয়েছে অন্বেষা ৩বি। চলতি মাসের ১৫ তারিখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাপানের কিউসু ইনস্টিটিউট টেকনোলজি'র মধ্যে ন্যানোস্যাটেলাইট নিয়ে গবেষণাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাদ আন্দালিব এবং কিউসু ইনস্টিটিউট টেকনোলজি'র পক্ষ থেকে প্রফেসর মেঙ্গু চো চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০১৭ সালের মে মাস নাগাদ স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে গ্রাউন্ড স্টেশন দলের সদস্য বিজয় তালুকদার জানান, স্যাটেলাইটটির কার্যকাল ছয় মাস। ছয় মাস পরে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে বায়ুমণ্ডলে পতিত হবে কিউবস্যাটটি। তিনি আরও জানান, কাজ চালানোর জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি অন্যান্য স্যাটেলাইটের মতো সূর্য থেকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হবে হাই-রেজুলিউশনের ক্যামেরা।

আব্দুল্লাহিল কাফি, মাইসুন ইবনে মনোয়ার এবং রায়হানা শামস ইসলাম অন্তরা।

মিশন

মাইসুন ইবনে মনোয়ার তার সাইটে উল্লেখ করেন, অন্বেষা ৩বি-এর প্রধান কাজ ছয়টি।

১। ক্যামেরা মিশন- স্যাটেলাইট থেকে বাংলাদেশের ছবি নেওয়া।

২। এসএনজি মিশন- স্যাটেলাইট থেকে অডিও ডাউনলোড করার সুবিধা, যা তরুণ প্রজন্মকে মহাশূন্য বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত করবে।

৩। এসইএল- মহাকাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ ও তথ্য প্রদান।

৪। পিওএস- স্যাটেলাইটের অবস্থান নির্ণয়।

৫। এটিএম- বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ।

৬। এনইটি- ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র তৈরি ও ব্যবহার উপোযোগী জ্ঞান অর্জন।

অন্বেষা ৩বি

বাংলাদেশের প্রথম ন্যানোস্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন

বাংলাদেশে গ্রাউন্ড স্টেশনের কাজ ২০১৫ থেকেই শুরু করেছেন বলে জানান প্রজেক্টের গ্রাউন্ড স্টেশন দলের সদস্য মোহাম্মদ সৌরভ। তিনি জানান, গ্রাউন্ড স্টেশন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই স্থাপিত হবে। ডেটা ডাউনলোডের ব্যাপারে আরেক সদস্য আয়নুল এমিল জানান, স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত তথ্য অ্যামেচার ব্যান্ড ব্যবহার করে গ্রাউন্ড স্টেশনে সংগ্রহ করা হবে। মহাশূন্যে কক্ষপথে ঘোরার সময় প্রতিদিন দুইবার বাংলাদেশের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন,  গ্রাউন্ড স্টেশনে ব্যবহারের জন্য সফটওয়্যারের উপরে কাজ চলছে। 

ছয় মাসের কার্যকালের পর পুনরায় একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন দলটির আরেক সদস্য সানন্দ জগতি চয়ন। স্যাটেলাইটটি বানাতে কত খরচ পড়েছে সে ব্যাপারে আপাতত চুপ থাকছে দলটি।