নির্বাচন, ফেইসবুক আর একজন ট্রাম্প

সারাবিশ্বে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত কিছু বিষয়ের মধ্যে একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর এ নিয়ে মুখর হয়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোও। প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোর উপর কতটুকু নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফল?

মোস্তফা মিনহাজ উদ্দিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2016, 01:45 PM
Updated : 27 April 2016, 01:45 PM

আমেরিকানদের দৈনন্দিন জীবনে ফেইসবুকের প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য যে কোনো উৎসের চেয়ে তারা ফেইসবুক থেকে বেশি খবর সংগ্রহ করে। তবে, তার মানে এমন নয় যে, আমেরিকায় নির্বাচনের প্রভাব বিস্তার করতে এর বড় কোনো ভূমিকা থাকতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মনোনয়নের জন্য লড়াইরত প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তি হলেন রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তাকে নির্বাচনী দৌড় থেকে সরিয়ে দিতে হয়তো মাঠে নামতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের সাইটটি। ফেইসবুক তাদেরর ‘অভূতপূর্ব’ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচন থেকে তাকে সরিয়ে দিতে পারে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোশাল নেটওয়ার্কটির কর্মীদের এমন কিছু করা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছেন।

প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগ গিজমডো এক প্রতিবেদনে জানায়, "গত মাসে (মার্চ) ফেইসবুকের কিছু কর্মী প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ-এর সঙ্গে 'ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ২০১৭ নির্বাচনে প্রতিহত করতে সহায়তা করা উচিত কিনা' সেই ব্যাপারে আলোচনা করেছে।

ফেইসবুকের কর্মচারীরা সম্ভবত রিপাবলিকান নেতাকে নিয়ে থাকা লাখ লাখ মার্কিনির ভয় প্রকাশ করছেন। যদিও প্রতিষ্ঠানটি ট্রাম্পবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটির অসাধারণ একটি ক্ষমতা হচ্ছে সামান্য একটি তথ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারা।

মূল ব্যাপারটি হচ্ছে ফেইসবুক এবং গুগলের মতো ইন্টারনেট জায়ান্টরা তাদের নিজস্ব নীতিতে কিছু পরিবর্তন করে নির্বাচনে প্রভাব ফেলার প্রকল্পিত দৃশ্য বছর ধরে চলে আসছে। হার্ভার্ডের আইন অধ্যাপক জোনাথান জিট্রেইন জানান, ২০১০ সালে কীভাবে 'ফেইসবুক কেউ কিছু বোঝার আগেই একটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঠিক করতে পারত।"

গোপন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে তারা দেশের নির্বাচনে একদিনের মধ্যে ৩ লাখ ৪০ হাজার ভোটার বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। যেখানে তারা ব্যবহারকারীদেরকে তাদের পরিচিত একজনের ছবি দেখিয়েছিল যাতে লেখা ছিল “আমি ভোট দিয়েছি”।

ফেইসবুক এই পরীক্ষা ২০১২ সালের নির্বাচনের সময়ও ব্যবহার করেছিল। যদিও পরীক্ষাটি কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করেনি। এটা ভোটারদেরকে ভোট প্রদান করতে উৎসাহিত করেছিল। ২০১৪ সালে ফেইসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ বলেন, "আমি ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে চাই যে, ফেইসবুক কারও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে না এবং কখনও করবেও না। ফেইসবুক কখনও নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি।"

ফেইসবুক পরিচালিত একটি 'বিতর্কিত' গবেষণা জনসম্মুখে আসার পর তিনি এই মন্তব্য করেন। সেখানে বলা হয়, ফেইসবুক গোপনে প্রায় ৭ লাখ মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করেছে।

৭৮ শতাংশ আমেরিকান কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করছেন। ফেইসবুকের মাধ্যমেই তারা দৈনন্দিন ঘটনার খবর জানতে পারে।

ফেইসবুক লাখ লাখ ভোটারের মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে এবং কীভাবে বিভিন্ন উপায়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের জন্য কাজে লাগাতে পারে তার ওপর একটি প্রতিবেদন এই বছরের শুরুতে প্রকাশ করে গার্ডিয়ান।

ফেইসবুক বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে, প্রার্থীরা যেন প্রতি ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করতে না পারে তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি 'অধীর' ছিল। কিন্তু তারা এখন প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারণায় তাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কে মেইলের তালিকা এবং ভোটারদের তথ্য আপলোড করতে অনুমতি দেয় যেখানে রাজনৈতিক অভ্যাস, প্রকৃত নাম, বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

পলিটিকো ম্যাগাজিনে ‘কীভাবে গুগল ২০১৬ নির্বাচনে কৌশল করতে পারে’- শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে গবেষণাধর্মী মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এপসটেইন বর্ণনা করেন, কীভাবে একটি গবেষণায় তিনি খুঁজে পান, "গুগলের অনুসন্ধানের গাণিতিক পরিভাষা সহজেই রিপাবলিকান দলের দ্বিধান্বিত ভোটারদের সিদ্ধান্তকে ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে।"

এপসটেইন বলেন, "এ ধরনের কৌশল অধিকাংশই অনিচ্ছাকৃত, গুগলে অনুসন্ধানের ফলাফল অন্যান্য অনুসন্ধানের জনপ্রিয়তার কারণে প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন কারণে সবসময় অ্যালগরিদমগুলো পরিবর্তিত হয়, আর কিছু 'ইঙ্গিত' মানুষ কীভাবে রাজনীতি দেখে তা প্রভাবিত করে। এর ফলে দেশের মানুষদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বদলে নির্বাচনে 'ক্ষতিকর প্রকৌশল' ঘটাতে পারে। যাই হোক, এমন সম্ভাবনা সেখানে থেকেই যায়, আর ফেইসবুকের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকি রয়ে যায়।"

আরও নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে, গণমাধ্যম ও প্রচারণা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক কর্পোরেশন অতীতে সব ধরনের উপায়ে নির্বাচন প্রভাবিত করতে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিকটি, এটা অর্থ, বিজ্ঞাপন, সম্পাদনা বা সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে হতে পারে। তবে, কখনোই কোনো একটি প্রতিষ্ঠান এত বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে নি। কিন্তু ইন্টারনেটে সংবাদ পড়ার যে ট্রাফিক, তার ৪০ শতাংশ ফেইসবুক থেকে আসে। আর এক্ষেত্রে পরিবর্তনটা 'অদৃশ্য' রেখেও করা সম্ভব।

ফেইসবুক যদি এমনটা করতে চায়, তবে তাদেরকে আটকানোর মতো কোনো আইন নেই বলে জানিয়েছে গিজমোডো। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, "ফেইসবুক চাইলে যে কোনো কনটেন্ট প্রচার বা ব্লক করতে পারে।" তারা চাইলে ট্রাম্প বা অন্য কাউকে পুরোপুরি ব্লক বা তার প্রচারণা করতে পারে।

বিদেশিদের নিয়ে 'আতঙ্ক', 'বর্বর' আর 'অস্থির' আচরণের কারণে ট্রাম্পের উপর বিরক্ত হয়ে ফেইসবুক ট্রাম্পবিরোধী কিছু করলে, সেটাকে 'স্বাগত' জানানো যায় বলে মন্তব্য গার্ডিয়ানের। অন্যদিকে, কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন ঘুরিয়ে দিলে, তা বিপদজনক হয়ে উঠবে। একবার এমনটা শুরু হলে, এটা আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এই বিশেষ ক্ষেত্রে হয়তো, জনগণ ফলাফল মেনে নেবে, কিন্তু ভবিষ্যতে সারাবিশ্বের নির্বাচনগুলোতে মার্ক জাকারবার্গ বা অজ্ঞাত পরিচয়ের কোনো প্রকৌশলীর রাজনৈতিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ হবে, এমনটা কি আমরা দেখতে যাই?- প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এই ব্রিটিশ দৈনিক।