বাণিজ্যে ফেইসবুক নির্ভরতা: বিকল্পের খোঁজে

বাংলাদেশে ১৮ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ফেইসবুক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা নিয়ে দেশে বিদেশের বাংলাদেশীরা সবাই কম বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিকল্প পন্থায় কেউ কেউ দেশে ফেইসবুক ব্যবহার করলেও ব্যবহারকারীদের বড় একটা অংশ সেবাটি থেকে বঞ্চিতই ছিলেন বলা যায়।

হাসিব বিন রফিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2015, 12:53 PM
Updated : 20 Dec 2015, 08:55 AM

ফেইসবুক বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেমন ভূমিকা রাখে সেটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজতত্ববিদদের আলোচনার জন্যেই না-হয় তোলা থাকল। কিন্তু এর মধ্যে ফেইসবুক আমাদের দৈনন্দিন অর্থ ও বাণিজ্যের বিভিন্ন শাখায় কীভাবে জালের মতো মিশে গিয়েছে আর সে কারণে ফেইসবুকের উপর নিষেধাজ্ঞা কীভাবে আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে সেটিই আজকের এই লেখার আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় এর একটি বিরাট অংশের ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা শেয়ার করার এই প্ল্যাটফর্মকেই তাই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা বেছে নেন তাদের পণ্যের খবর সম্ভাব্য ক্রেতাকে জানানোর জন্যে। ফেইসবুকে পেইজ কিংবা গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন পোষ্ট ও ছবি দেখে পণ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। ফেইসবুক-এর এই পেইজ কিংবা গ্রুপগুলো মূলত পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করার কথা থাকলেও অনেকেই অত্যুৎসাহী হয়ে এর মাধ্যমেই ইনবক্সে অর্ডার নিতে শুরু করেন। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে F-Commerce বা ফেইসবুক ব্যবসা।

দেশের সফটওয়্যার খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন প্রতি সপ্তাহে অনলাইনে প্রায় দেড় কোটি টাকার পণ্য ও সেবা লেনদেন হয়।

বেসিসের হিসাবে প্রায় এক হাজার ওয়েব পেইজ আছে, যারা ফেইসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ব্যবসা করে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইক্যাব)-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবসা করেন এমন ফেইসবুক পেইজ আছে সাড়ে ৭ হাজার।

ফেইসবুক বন্ধ থাকার কারণে এই খাত বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যেহেতু ফেইসবুক নির্ভর উদ্যোক্তারা সবাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি তাই তাদের সীমিত পুঁজিও পরেছে হুমকির মুখে। নতুন কোন অর্ডার আসছিল না, অনেক অর্ডার আগে পেয়েছিলেন কিন্তু ডেলিভারি দিতে পারেননি। কারণ ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমই ছিল ফেইসবুক।

যেহেতু ক্রেতারা ফেইসবুক অ্যাক্সেস করতে পারছিলেন না তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছিল না। ফেইসবুক পেইজ ক্রেজি মার্টের প্রধান এএস রিফাত জানান, ফেইসবুকে আগে তিনি অর্ডার পেতেন দৈনিক ৪০ থেকে ৪৫টি। কিন্তু ফেইসবুক বন্ধ থাকার ২২ দিনের মধ্যে তিনি সাকুল্যে ৪০টি অর্ডারও পাননি।

প্রতি দিন তার গড় বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার টাকা। এই বিক্রির পরিমাণও তাই কমে এসেছিল আনুপাতিক হারে। ইক্যাবের সভাপতি রাজীব আহমেদ জানান, ফেইসবুক বন্ধের ২২ দিনে ইকমার্স ব্যবসায়ীদের অর্ডার এর পরিমাণ সাধারণ সময়ের থেকে ৭০% এর মতো কমে গিয়েছিল। আর যারা শুধু ফেইসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করেন তাদের অর্ডার এর পরিমাণ কমে গিয়েছিল ৯০% এর মত। সব মিলিয়ে বিশাল এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিশ্রুতিশীল ইকমার্স খাতে।

ফেইসবুকের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠা এই বিশাল উদ্যোক্তাশ্রেণীর কি তবে আর কোন সমাধান নেই? ফেইসবুক এভাবে হঠাৎ বন্ধ থাকলে কিংবা পেইজ রিপোর্ট হয়ে বন্ধ হয়ে গেলে কি তাদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে? যদি একটি নিজের অনলাইন স্টোর থাকে তবে এই সমস্যা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। অনলাইন স্টোর এর ক্রেতা সমাগম কখনও ফেইসবুকের কোন সিদ্ধান্তের জন্যে আটকে থাকবে না। ফেইসবুক পেইজ বিশ্বজুড়ে মূলত ব্যবহার হয় অনলাইন মার্কেটিং এর জন্যে। কিন্তু ক্রেতাকে সম্পূর্ণ অনলাইন কেনাকাটার অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে নিজস্ব ওয়েবসাইটের বিকল্প নেই। আর ক্রেতার জন্যে যদি আলাদা লগ-ইন এর অপশন থাকে তবে এতে বিক্রেতা সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা নিতে পারেন।

চীনে যে ফেইসবুক নেই তাতে করে তাদের অনলাইন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়নি উপরন্তু তাদের দেশ থেকেই আলিবাবার মত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স ব্যবসার উদ্ভব হয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিক্রির তাই কোন বিকল্প নেই।

এমন পরিস্থিতিতে সমাধান হতে পারে স্টোরিয়া বা ঘুড়ির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো।

নতুন উদ্যোক্তারা এই ধরনের মার্কেটপ্লেসে বিনা খরচে নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্য আপলোড করতে পারেন। ব্যবসার মূল কাজগুলোর পাশাপাশি নিজের ওয়েবসাইট নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন বিক্রেতা। যখনই নতুন পণ্য আসবে তখনই নিজেই আপলোড করতে পারবেন একজন অনলাইন মার্চেন্ট। আর এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে ওয়েবসাইট বানাতে তেমন কোনো কারিগরি জ্ঞানেরও প্রয়োজন নেই।

মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটের একটি কথা স্মরণ করা যেতে পারে এখানে। তিনি বলেছেন, “কখনও আয়ের জন্য একটি উৎসের উপর নির্ভর করে থাকবেন না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় উৎসের খোঁজ রাখুন।” যারা স্রেফ ফেইসবুকের উপর নির্ভর করে ব্যবসা করার চিন্তা করছেন, তাদের সম্ভবত ভিন্ন পথে চিন্তা করার সময় এসেছে।

লেখক: প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।