সমন্বয়ের জটিলতায় ‘ফাঁদে’ পুঁজিবাজার

ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো নিয়ে জটিলতায় ভুগছে পুঁজিবাজার।

ফারহান ফেরদৌসআবদুর রহিম হারমাছি ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2016, 03:30 PM
Updated : 27 April 2016, 04:02 PM

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, সময়সীমা বাড়ানোর ইস্যুতে এক ধরনের ‘আস্থাহীনতা’ রয়েছে বাজারে; যার ফলে প্রতিদিনই সূচক কমছে।

সর্বশেষ নয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক একচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৭০ পয়েন্ট কমে ৪২৩৯ পয়েন্টে নেমে আসে, যা প্রায় এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

গত বছরের ৭ মে ডিএসইতে এই সূচক ছিল ৪১২২ পয়েন্ট।

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে না পেরে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

আর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ নিয়ে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাজার বিশ্লেষক এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরান হাসান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, “এই সীমা আদৌ বাড়ানো হবে কীনা, বাড়ালেও কবে কতো দিন বাড়ানো হবে- তার কোনো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে।”

বাজার পড়ার পেছনে এই আস্থাহীনতাকেই কারণ হিসেবে বলেন তিনি।

অবশ্য গত কয়েক দিনে ডিএসইতে সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে।

এ বিষয়ে এমরান হাসান বলেন, “শেয়ারের দাম কমলেও যদি লেনদেন বাড়ে এর অর্থ হচ্ছে পুঁজিবাজারে আস্থা নেই। বিনিয়োগকারীরা ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। দাম আরও কমবে- এমন আতঙ্কে রয়েছেন সবাই।”

ব্রোকারেজ হাউজ ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদিক বলেন, “আমি বুঝি না, কারও কি পুঁজিবাজার নিয়ে কোন চিন্তা আছে? সবাই যে বলে দেশে অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে; ভাইব্রেন্ট পুঁজিবাজার ছাড়া কোনো দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে কি?”

পুঁজিবাজার নিয়ে নীতি নির্ধারকদের কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি সংগঠনের সভাপতি আতাউল্লাহ নাইম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিনিয়োগকারীদের আশা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আসার পরে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের সীমা বাড়বে এবং পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো হবে কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি।”

তবে শেয়ার ‘ছেড়ে দেওয়ার’ কারণ হিসেবে কম মুনাফার কথা বলছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ।

তিনি বলেছেন, “বিনিয়োগকারীরা কম মুনাফা হলেই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, এ কারণেই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব।”

গত বছরের ১৫ নভেম্বর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা দুই বছর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, “অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত করা হবে। এরপর আমরা গেলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলে এটি আসতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। গেলাম অর্থ মন্ত্রণালয়ে…।

“অর্থ মন্ত্রণালয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কাছে চিঠি লিখলে আমরা ‘ওকে’ করে দেব। এই করতে করতে এ বিষয়ে জড়িত হলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে গেলাম। তিনি পুঁজিবাজারের স্বার্থে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন।”

“এরপর অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের সামনে কথা দিয়েছেন বিনিয়োগ সমন্বয় সীমা বাড়ানো হবে। সে সময় অর্থ সচিবও উপস্থিত ছিলেন। আমরা খতিয়ে দেখলাম যে আইনে বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেই আইন পরিবর্তন না করেই সমন্বয়ের সীমা বাড়ানোর সুযোগ আছে।

“এখন শুনছি কায়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে, এই সুযোগ দেওয়া হলে বাজার মেনুপুলেট (কারসাজি) ও বাবল হবে।”

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমরা যদি ব্যক্তি বিশেষকে শিল্পায়নের জন্য ৫০০ কোটি টাকার উপরে ১৫ বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত রিসিডিউল (ঋণ পুনঃতফসিল) করার সুযোগ দিতে পারি, তাহলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর জন্য এ কাজটি (বিনিয়োগ সমন্বয় সীমা বাড়ানো) কারতে পারি না?”

“আমরা টাকা চাচ্ছি না, সহায়তা চাচ্ছি না, কোন ফান্ড চাচ্ছি না। আমরা শুধু পলিসি সাপোর্ট (নীতি সহায়তা) চাচ্ছি,” বলেন রকিবুর রহমান।

ডিএসইর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ সমন্বয় করা নিয়ে কেন এই খেলা খেলছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে ধীরে ধীরে পুঁজিবাজার ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজারের গলার টুটি টিপে ধরে আছে। এ ধরনের কার্যকালাপ বন্ধ করতে হবে।”

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের (পরিশোধিত মূলধন, স্ট্যাটিউটরি রিজার্ভ, রিটেইনড আর্নিং ও শেয়ার প্রিমিয়ামের যোগফল) সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিনিয়োগ সীমা বেঁধে দিয়েছিল।

২০১০ সালে বেশ কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগের প্রেক্ষিতে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই সীমা বেঁধে দেয়।

একইসঙ্গে যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি আছে তাদের তা কমিয়ে সীমার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য ২০১৬ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা নিয়ে নানা জটিলতার মধ্যেই সোমবার মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয় সীমা বাড়ানো পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, “এখন ব্যাংকে যে পরিমাণ অলস টাকা পড়ে আছে, সেখানে আরও টাকা দিলে অলস টাকা বাড়বে। অলস টাকা বাড়লে ব্যাংক আমানত নিতে অস্বীকার করবে। আমার মনে হয় এই মুহুর্তে বেশি টাকা ব্যাংকের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত হবে না। কাজেই ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।”

এদিকে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময় ২০১৬ সালের ২১ জুলাইয়ের পর না বাড়িয়ে ‘নীতি সহায়তা’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।