বার্সার সাফল্যের ১০ কারণ

গেল মৌসুমটা খালি হাতে শেষ করার হতাশা কি দুর্দান্তভাবেই না পেছনে ফেলল বার্সেলোনা। রোববার রাতে গতবারের লা লিগা চ্যাম্পিয়ন আতলেতিকো মাদ্রিদের মাঠে লিওনেল মেসির একমাত্র গোলে জিতে এক ম্যাচ হাতে রেখে লিগ শিরোপা ঘরে তোলার পর তাদের সামনে আছে ‘ট্রেবল’ জয়ের হাতছানিও।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2015, 04:16 PM
Updated : 18 May 2015, 04:33 PM

আগামী ৩০ মে কোপা দেল রে ফাইনালে আথলেতিক বিলবাও এবং ৬ জুন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ইউভেন্তুসকে হারালেই দ্বিতীয়বারের মতো ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব গড়বে তারা। 

এক বছরের ব্যবধানে কাতালুনিয়ার দলটির এমন ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে রহস্য কি? টানা চারবারের বর্ষসেরা মেসির জাদু আর লুইস এনরিকের পরিকল্পনা তো আছেই, সঙ্গে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি কারণ।

১. মেসি জাদু

২০১৩-১৪ মৌসুমেও কোনো অংশে খারাপ খেলেননি লিওনেল মেসি, নিয়মিত গোলও করেছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে তার চমৎকার পারফরম্যান্সের তুলনায় সেটা কিছুটা কমই ছিল। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ওই মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে নিজেকে ঠিক মেলে ধরতে পারেননি তিনি।

এই মৌসুমের শুরুতেও তার প্রভাব কিছুটা ছিল, কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই স্বরূপে ফিরেন মেসি। আর এখন তো তিনি আছেন নিজের সেরা ফর্মে।

২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ এই দুই মৌসুমে মেসির গোল করা আর করানোর হিসেব দেখলেই পুরো বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শিরোপা খরায় কাটা আগের মৌসুমে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ক্লাবের হয়ে ৪৬ ম্যাচ খেলে ৪১ গোল করেন আর ১৪টি গোল করান। আর এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৫৪ ম্যাচে ৫৪টি গোল করেন আর ২৭ গোল করিয়েছেন বার্সেলোনার সেরা তারকা। 

২. সুয়ারেসের উপস্থিতি

আক্রমণভাগে লুইস সুয়ারেসের উপস্থিতি, মাঠ জুড়ে তার ছুটে চলা এবং বিশেষ করে প্রতিপক্ষের গোলমুখে তার দ্রুত গতিতে ঢুকে পড়ার ক্ষমতা মেসিকে আরও বেশি স্বাধীনভাবে খেলতে সাহায্য করেছে। বার্সেলোনার হয়ে অভিষেক মৌসুমে মোট ২৪টি গোল করেছেন উরুগুয়ের এই স্ট্রাইকার, কিন্তু স্পেনের অন্যতম সফল ক্লাবটির এমন ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সুয়ারেসের অবদান শুধু তার গোলসংখ্যাতে পুরোটা বোঝা যায় না।

এই পরিসংখ্যানের চেয়েও গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো মাঠে সুয়ারেসের অক্লান্ত পরিশ্রম আর বল পায়ে তার চমৎকার, বুদ্দিদীপ্ত চলাফেরা। ফলে অধিকাংশ ম্যাচেই প্রতিপক্ষের রক্ষণকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে। আর এই কারণে মেসি ও নেইমারের সামনে গোল করার অনেক বেশি সুযোগ তৈরি হয়।

সাড়ে সাত কোটি পাউন্ডের বিনিময়ে কেনা সুয়ারেসের উজ্জ্বল উপস্থিতিই মূলত বার্সেলোনার আক্রমণভাগকে রীতিমত ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। যাকে পাশে পেয়ে মেসি ও নেইমার নিজেদের পুরোটা মেলে ধরতে পেরেছেন। এই মৌসুমে ‘এমএসএন’ ত্রয়ী একত্রে ১১৫টি গোল করেছে, যার মধ্যে ৭৯টি এসেছে লা লিগায়।

২০১৪-১৫ মৌসুমে লিগে এখন পর্যন্ত বার্সেলোনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪১টি গোল করেছেন মেসি। আর নেইমার ২২ ও সুয়ারেস ১৬টি গোল করেন।

৩. নতুন ফুটবল শৈলীর ধারাবাহিকতা

মৌসুমের প্রথম কয়েকটা মাসে বার্সেলোনা ম্যাচ জিতলেও তাদের পারফরম্যান্সে ছন্দের বড্ড অভাব ছিল। দল হিসেবে খেলার চেয়ে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল তারা।

এর পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায় গত ডিসেম্বরে এসপানিওলের বিপক্ষে তাদের লিগ ম্যাচে। ওই ম্যাচে প্রথমার্ধের অধিকাংশ সময় ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পর মেসির একার নৈপুণ্যেই মূলত শেষ পর্যন্ত ৫-১ গোলে জেতে বার্সেলোনা। ঘরের মাঠের ওই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। মেসি জাদুতে এসপানিওলের বিপক্ষে ওই ম্যাচে বড় জয় পেলেও মালাগা, সেল্তা ভিগো, গেতাফে ও রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে কিন্তু পয়েন্ট হারাতেই হয় বার্সেলোনাকে। এতে তাদের শিরোপা স্বপ্ন বড় একটা ধাক্কাই খেয়েছিল।

তবে এই বছরের শুরু থেকে নিজেদের খেলার ধরণে পরিবর্তন আনেন কোচ এনরিকে। তিনি মূলত ক্লাবের গতানুগতিক আক্রমণের কৌশল পাল্টে দেন। অনেক বছর ধরে মাঝ মাঠ কেন্দ্রিক পাসিং ফুটবল ছেড়ে মেসি-নেইমার-সুয়ারেস ত্রয়ীর আক্রমণের উপর জোর দেন এনরিকে।

৪. সেট-পিস দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা

ফ্রি-কিক আর কর্নার থেকে গোল করতে না পারাটা গত মৌসুমে নিশ্চিতভাবেই বার্সেলোনার বড় দুর্বলতা ছিল। শুধু গোল করার ব্যর্থতায় নয়, এই দুই ক্ষেত্রে সবসময়ই মনে হতো, এই বুঝি গোল খেয়ে বসল দলটি। সাবেক কোচ তাতা মার্তিনো তো নিজের খেলোয়াড়দের ‘লম্বায় ছোট বলে’ সেটাকে মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু এনরিকে পুরো চিত্রই পাল্টে দিলেন। এখন মাঠের দুই দিকেই বার্সেলোনা হয়ে উঠেছে সেট-পিস বিশেষজ্ঞ।

গত সপ্তাহে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমি-ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে প্রথম গোলটি কর্নার থেকে হজম করে বার্সেলোনা। গত অক্টোবর থেকে এটাই ছিল কর্নার বা ফ্রি কিক থেকে তাদের জালে প্রথম গোল। এই সময়ে লিগে এইবারের বিপক্ষে শূন্যে ঝাঁপিয়ে কর্নারে হেড করে মেসিও একটি গোল করেন।

৫. আতলেতিকোকে সামাল দেওয়া

বার্সেলোনার শিরোপাহীন গত মৌসুমের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে তাদের হতশ্রী পারফরম্যান্স। সব প্রতিযোগিতা মিলে সেবার মোট ছয়বারের মুখোমুখি লড়াইয়ে একবারও জিততে পারেনি মেসিরা। ওই ম্যাচগুলোতে মাত্র ৩টি গোল করতে পারে তারা। যার মধ্যে লিগের শেষ রাউন্ডে ঘরের মাঠে ১-১ গোলে ড্র করে শিরোপা হারায় বার্সেলোনা।

এবারের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন, আড়াই সপ্তাহের মধ্যে তিনবারের মুখোমুখি লড়াইয়ের সবকটিতে জেতে বার্সেলোনা। আর গত রোববার আতলেতিকোর মাঠে জিতেই তো লিগ শিরোপা নিশ্চিত করল দলটি।

৬. খেলোয়াড় কেনায় সফল

জেনে বুঝে খেলোয়াড় কেনাটাও বার্সেলোনার এবারের সাফল্যের অন্যতম কারণ। বড় উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে ইভান রাকিতিচের নাম। গত গ্রীষ্মে কাম্প নউয়ে যোগ দেওয়ার পর ক্লাবটির হয়ে ৩১টি লিগ ম্যাচে খেলেছেন ক্রেয়েশিয়ার এই মিডফিল্ডার, এই মৌসুম শেষে বার্সেলোনা ছাড়তে যাওয়া তারকা মিডফিল্ডার চাভির জায়গায়ও বড় ভূমিকা রাখেন তিনি।

রিয়াল সোসিয়েদাদ থেকে গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভোকে কেনাটাও দারুণ সফল বলেই বিবেচিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত একটি মাত্র বড় ভুল করতে দেখা গেছে চিলির এই গোলরক্ষককে। এছাড়া জার্মান গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেনও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আশানুরূপ পারফর্ম করেছেন।

ফরাসি ডিফেন্ডার জেরেমি মাথিউয়ের অন্তর্ভুক্তিও দারুণ সফল, দ্রুতই জেরার্দ পিকে ও হাভিয়ের মাসচেরানোর পাশে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি।

আর লিভারপুল থেকে লুইস সুয়ারেসের আসাটা তো বার্সেলোনার আক্রমণভাগের চেহারটাই বদলে দিয়েছে। 

৭. আক্রমণে সফল, রক্ষণেও

বার্সেলোনার সফল পথচলায় মূল আলোটা মেসি-নেইমার-সুয়ারেস আক্রমণ ত্রয়ীর উপর থাকলেও মাঠের অন্যান্য জায়গায়ও দারুণ সফল তারা।

এই মৌসুমের শুরুতে ক্লাবটির রক্ষণের সক্ষমতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, যা তাদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দানি আলভেস আর জেরার্দ পিকে পুরনো রূপে ফেরেন। তাই ৩৭ ম্যাচের ২৩টিতেই প্রতিপক্ষ খুঁজে পায়নি বার্সেলোনার জাল। লিগের এই কয় ম্যাচে মাত্র ১৯ গোল খায় তারা।

স্প্যানিশ তারকা পিকে তো আবারও নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্রাজিলের আলভেসও সেরা ফর্মে ফিরেছেন। আর জরদি আলবার অবিরাম প্রাণশক্তি এবং মাসচেরানোর দায়বদ্ধতা বার্সার রক্ষণকে দুর্দান্ত চারে পরিণত করেছে।

৮. চোট ভাগ্য

গত কয়েক মাসে রিয়াল মাদ্রিদ একের পর এক চোট সমস্যায় ভুগছে। কখনও একসঙ্গে একাধিক মূল খেলোয়াড়দের চোটে পড়েছেন। বিভিন্ন সময়ে খেলতে পারেননি নিয়মিত একাদশের লুকা মদ্রিচ, হামেস রদ্রিগেস, গ্যারেথ বেল, করিম বেনজেমা, সের্হিও রামোস ও পেপে। 

এদিক থেকে বার্সেলোনার ভাগ্য ছিল বেশ ভালো। এনরিকে পুরো শক্তির দল নিয়ে মৌসুমের শেষ ধাপে পা রাখেন। এমনকি আর্সেনাল থেকে আসা টমাস ভারমেলনও চোট কাটিয়ে মাঠে ফেরেন।

৯. মাদ্রিদের দুই দলের ব্যর্থতা

লা লিগার গত পাঁচ মৌসুমের দুইবারই ৯৬ পয়েন্ট পেয়েও শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয় বার্সেলোনা। কিন্তু তাদেরকে এবার রাজধানীর দুই দল ততটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি।

আতলেতিকো মাদ্রিদ খুব ভালো দল হওয়ার পরও এবার তারা ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারেনি, যা গতবার তাদের চ্যাম্পিয়ন করেছিল।

আর গত ডিসেম্বরে রিয়াল মাদ্রিদের পারফরম্যান্স ছিল চূড়ায়। ওই সময় টানা ২২ জয়ের পথচলার শেষ দিকে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে ইউরোপের সফলতম দলটি। কিন্তু এরপর তারা জয়ের পথ থেকে ছিটকে পড়ে। বারবার হোঁচট খেয়ে বার্সেলোনার শিরোপা জয়ের পথটা সহজ করে দেয় কার্লো আনচেলত্তির দল।

১০. এনরিকে- তিনিই আসল নেতা?

জেরার্দ মার্তিনোর জায়গায় বার্সেলোনার কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মৌসুমের শুরুটা ততটা আশাব্যাঞ্জক ছিল না লুইস এনরিকের। গত জানুয়ারিতে তো মূল তারকা মেসির সঙ্গে তার বিরোধ নিয়েও গুঞ্জন ওঠে। মেসির দল বদলের সম্ভাবনা নিয়েও গুঞ্জন ওঠে।

ওই বিরোধের মূল কারণ নাকি ছিল- মেসি ও এনরিকের মধ্যে ‘কে মূল নেতা’- এই প্রশ্ন। এটা ঘিরে দুই জনের সম্পর্কও বাজে অবস্থায় চলে যায়। তবে ধীরে ধীরে সব ‘গুজব’ থেমে যায়। প্রতিপক্ষের জন্য বার্সেলোনা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর দল।

এরই সঙ্গে ফুটবলে প্রচলিত একটা কথাও আরেকবার সত্য বলে ধরা দিল, ড্রেসিং রুমে কড়া নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো কোচই অনেক মাস ধরে সাফল্য উপভোগ করতে পারেন না।

দলের অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে এনরিকের খারাপ সম্পর্কের গুঞ্জন থাকলেও, বার্সেলোনার এই সাফল্যে ফুটবলে প্রচলিত আরেকটা কথাও প্রমাণিত হয় যে, কোচকে সফল হতে জনপ্রিয় হওয়ার দরকার নেই।