রিয়ালের লা লিগা জয়ের ৫ কারণ

স্পেনের শীর্ষ লিগে বার্সেলোনার কয়েক বছরের আধিপত্য ঘুঁচিয়ে অবশেষে শিরোপা জিততে পেরেছে রিয়াল মাদ্রিদ। আর তা সম্ভব হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে জিনেদিন জিদানের দলের শক্তির গভীরতা বেশি হওয়ায়। তুলনামূলক দুর্বল দলের বিপক্ষে বার্সেলোনার হোঁচটও মাদ্রিদের শিরোপা জয়ে প্রভাব রেখেছে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2017, 05:45 PM
Updated : 22 May 2017, 06:06 PM

মৌসুম জুড়ে জিদানের খেলোয়াড় রদবদল করে খেলানোর পরিকল্পনাও দারুণ ফলপ্রসু হয়েছে। বড় ম্যাচের আগে মূল একাদশের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের বিশ্রাম দেওয়ায় সঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পেরেছেন তারা। আর বেঞ্চের খেলোয়াড়রা সুযোগ পেয়ে কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে।

সব মিলিয়ে মৌসুম জুড়ে দারুণ ছন্দে ছুটেছে রিয়াল। রোববার রাতে মালাগাকে ২-০ গোলে হারিয়ে ৩৩তম লা লিগা শিরোপা জিতেছে দলটি। গড়েছে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লিগের এক আসরের সব ম্যাচে গোল করার কীর্তি।

২০১২ সালের পর রিয়াল মাদ্রিদের লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে রয়েছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

দলের প্রায় সবাইকে কাজে লাগিয়েয়েছে জিদান

এর আগে অনেকে যা ভাবতেই পারতেন না এবার তাই সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছেন জিদান। দলের সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে অনেক ম্যাচে বিশ্রাম দেন তিনি। চোটের কারণে মৌসুমের অধিকাংশ সময় তো দলেই ছিলেন না গ্যারেথ বেল।

ফরাসি এই কোচ এবার রোনালদোকে নয়টি লিগ ম্যাচে বিশ্রামে রাখেন। চারবারের বর্ষসেরা ফুটবলারকে তিনি এই মৌসুমে খেলিয়েছেন দুই হাজার ৫৪৪ মিনিট যেখানে গত মৌসুমে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড খেলেছিলেন তিন হাজার ১৮৩ মিনিট।

তাতে দারুণ ফলও পায় রিয়াল; দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তের জ্বলে উঠেন রোনালদো। শেষ ম্যাচে মালাগার বিপক্ষে দলকে এগিয়ে দেওয়াসহ সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে শেষ নয় ম্যাচে ১৪ গোল করেন তিনি।

আর তার অনুপস্থিতিতে আলো ছড়ান মার্কো আসেনসিও, লুকাস ভাসকেস ও আলভারো মোরাতা। প্রথম একাদশে অনিয়মিত মোরাতা খুব বেশি খেলার সুযোগ না পেয়েও এবারের লিগে ১৫ গোল করেন।  

গুরুত্বপূর্ণ কাসেমিরো ও অবিশ্বাস্য মার্সেলো

 

রিয়ালের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে ব্রাজিলের এই দুই খেলোয়াড়ের অবদানের কথা আলাদা করে না বললেই নয়, ডিফেন্সিভ-মিডফিল্ডার কাসেমিরো ও ডিফেন্ডার মার্সেলো।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গত আসরের ফাইনালে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে দারুণ পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা এবার পুরো মৌসুমে ধরে রাখেন কাসেমিরো। প্রতিপক্ষের থেকে বল কেড়ে নিয়ে সতীর্থ দুই মিডফিল্ডার টনি ক্রুস ও লুকা মদ্রিচকে যোগান দেওয়ায় সবসময়ই দারুণ ভূমিকা ছিল কাসেমিরোর।

এই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে কাসেমিরোসহ খেলা ৪০ ম্যাচে রিয়ালের জয়ের হার ৭৫.৬ শতাংশ। আর তাকে ছাড়া ৬৬.৭ শতাংশ।

মার্সেলোর ভূমিকা তো খালি চোখেই স্পষ্ট। লেফট-ব্যাক হয়েও দলের অনেক আক্রমণের উৎস তিনি। রিয়ালের আক্রমণভাগে বিশেষ করে রোনালদোর সঙ্গে তার বোঝাপড়া চমৎকার। পরিসংখ্যানও তাই বলে; চলতি মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে প্রথম ডিফেন্ডার হিসেবে সতীর্থদের দিয়ে ১০টি গোল করান তিনি।

বার্সেলোনার অবাক করা সব হোঁচট

 

গত চার মৌসুমে তিনবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বার্সেলোনার সামনে ছিল টানা তৃতীয় শিরোপার হাতছানি। লিওনেল মেসি, নেইমার ও লুইস সুয়ারেসে গড়া বিশ্বসেরা আক্রমণভাগের উপর ভর করে সে স্বপ্নই দেখছিল দলটি। বড় ম্যাচগুলোয় তাদের পারফরম্যান্সও ছিল নজরকাড়া; কিন্তু তুলনামূলক দুর্বল দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারানোই শেষ পর্যন্ত কাল হলো কাতালান ক্লাবটির।

লিগ টেবিলের শীর্ষ চারে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে সর্বোচ্চ ১৮ পয়েন্টের মধ্যে ১৪ পয়েন্ট পায় বার্সেলোনা। সেভিয়ার বিপক্ষে তারা দুটি ম্যাচই জিতে, জয় তুলে নেয় আতলেতিকো মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদের মাঠেও।

অন্যদিকে, শীর্ষ চারে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে রিয়াল পায় মাত্র ৮ পয়েন্ট। এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও আলাভেস, সেল্তা ভিগো, দেপোর্তিভো লা করুনা ও মালাগার কাছে হেরে বসে বার্সেলোনা। তবে এই চার দলের সবার বিপক্ষেই জয় পায় রিয়াল।

এবারের লিগে বার্সেলোনার প্রথম পরাজয় গত সেপ্টেম্বরে, আলাভেসের কাছে ঘরের মাঠে ২-১ গোলে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেল্টিকের বিপক্ষে ম্যাচ থাকায় লিগের ওই ম্যাচে লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেস ও আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন লুইস এনরিকে। কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্ত বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বার্সেলোনা দ্বিতীয় ম্যাচ হারে সেল্তা ভিগোর কাছে। প্রতিপক্ষের মাঠে ৪-৩ গোলে হারের ওই ম্যাচে চোটের কারণে ছিলেন না মেসি আর প্রথমার্ধে বেঞ্চে ছিলেন ইনিয়েস্তা।

দেপোর্তিভোর মাঠে ২-১ গোলে হারা ম্যাচে বার্সেলোনা শিবিরে নেইমারের শূন্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার আগের সপ্তাহেই ব্রাজিলিয়ান তারকা ফরোয়ার্ডের অসাধারণ নৈপুণ্যে পিএসজিকে ৬-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেরা প্রত্যাবর্তনের রেকর্ড গড়েছিল কাম্প নউয়ের ক্লাবটি।

আর গত এপ্রিলে মালাগার মাঠে জেরার্দ পিকে ও ইভান রাকিতিচকে ছাড়া খেলতে নামা বার্সেলোনা হেরে বসে ২-০ গোলে।

বার্সেলোনাকে হারানো সব দলের বিপক্ষেই জিতে রিয়াল। বার্সেলোনার কাছ থেকে পয়েন্ট ছিনিয়ে নেওয়া রিয়াল সোসিয়েদাদ ও রিয়াল বেতিসকেও সহজে হারায় জিদানের দল।

রোনালদো-বেনজেমাদের অনুপস্থিতিতে সুযোগ পেয়ে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন ইসকো, মার্কো আসেনসিও ও আলভারো মোরাতা। বার্সেলোনার কাছে ৩-২ গোলে হারা দলের নয় জনকে বসিয়ে এপ্রিলে দেপোর্তিভোর বিপক্ষে খেলতে নামে রিয়াল। সেরাদের ছাড়াই ম্যাচটি ৬-২ গোলে জিতে যায় তারা, এই ম্যাচে তাদের মোট পাঁচ জন গোল করেন। ওই একই খেলোয়াড়েরা গ্রানাদাকে ৪-০, লেগানেসেকে ৪-২ ও এইবারকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয়।

ডায়মন্ড ফর্মেশন, ইসকো ও মধ্যমণি রোনালদো

 

ঘরোয়া ফুটবল ও ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতায় রিয়ালের পারফরম্যান্সে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মৌসুমের অধিকাংশ সময় অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড গ্যারেথ বেলকে ছাড়াও তারা ছন্দ ধরে রাখে।

বেলের অনুপস্থিতিতে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানিয়ে নেয় তারা। নিজেদের ফর্মেশন ৪-৪-২ ডায়মন্ডে পাল্টে ফেলে মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে ফেলে। এই কৌশলে কাসেমিরোকে অনেক জায়গা ছেড়ে সামনে উঠে খেলে মদ্রিচ ও ক্রুস।

আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে দুর্দান্ত খেলা ইসকো ১০ গোল করেন ও আটটি গোল করান। আর পছন্দের পজিশন লেফট-উইং ছেড়ে সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার হিসেবে মানিয়ে নিয়েছেন রোনালদো।

পর্তুগিজ এই তারকা এবারের লিগে করেছেন ২৫ গোল। এর মধ্যে পাঁচটি মৌসুমের শেষ ধাপে ভালেন্সিয়া, সেভিয়া ও সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে। আর এই ম্যাচগুলো জিতেই শিরোপার ১ পয়েন্টের ব্যবধানে চলে আসে রিয়াল।   

টানা ৬৪ ম্যাচে ম্যাচে গোল

মাদ্রিদের দলটির জন্য গোল করা আসলে কোনো সমস্যাই নয়। বেল থাকুক বা না থাকুক- দীর্ঘদিন ধরে তারা এটা প্রমাণ করে আসছে, তাদের রোখা খুব কঠিন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ৬৪ ম্যাচে গোল করেছে জিদানের শিষ্যরা।

পুরো মৌসুমে প্রতিপক্ষের গোলমুখে বার্সেলোনাও ছিল দুর্দান্ত। লিগের মাত্র দুটি ম্যাচে গোল করতে ব্যর্থ হয় তারা- মালাগা বিপক্ষে দুই লেগে। এই দুই ম্যাচে তারা হারায় ৪ পয়েন্ট, যা না হারালে শিরোপা ধরে রাখতে পারতো কাতালান ক্লাবটি। রয়টার্স, ফোরফোরটু।