‘পাইপলাইনে ফুটবলার নেই’

বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালী প্রজন্মের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার আশীষ ভদ্র আলো ছড়িয়েছেন আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান স্পোর্টিংয়ে হয়েও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ৫৭ বছর বয়সী এই সাবেক মিডফিল্ডার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে বাংলাদেশের তিন দলের ব্যর্থতা, জাতীয় দলের সাম্প্রতিক ভরাডুবি নিয়ে কথা বললেন। ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে সময়-এ সময়ের ফুটবলের ব্যবধানও তুলে ধরলেন।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2017, 03:42 PM
Updated : 1 March 2017, 03:43 PM

প্রশ্ন: চট্টগ্রাম আবাহনী থেকেই আপনার উঠে আসা...

আশীষ ভদ্র: এটা আমাদের পাড়ার টিম ছিল। তামিমের বাবা ইকবাল ভাইয়ের দল ছিল এটি। তখন নাম ছিল কেকেআরসি (কাজীর দেউড়ি খাজা রিক্রিয়েশন ক্লাব)। আমরা ১৯৭৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হলাম, তখন নাম বদলে হলো চট্টগ্রাম আবাহনী।

শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ থেকে ছিটকে গেল আপনার দল। নিশ্চয় ব্যথিত?

আশীষ ভদ্র:  কোরিয়ার দলটি শক্তিশালী। আমরা যখন খেলতাম, তখনও কঠিন দল ছিল ওরা। ওদের স্ট্যান্ডার্ড ভালো। যখন শুনলাম ওটা চতুর্থ সারির চ্যাম্পিয়ন, তখন সাধারণ দল হিসেবে নিয়েছি। কিন্তু ওদের প্রথম খেলা দেখেই মনে হয়েছে ভালো দল। টিম ওয়ার্ক ভালো। ছোট জায়গায় খুব দ্রুত খেলে। শ্রেয়তর দল হিসেবেই জিতেছে তারা।

চট্টগ্রাম আবাহনীর খেলা?

আশীষ ভদ্র: চট্টগ্রাম আবাহনীর পারফরম্যান্স তত ভালো ছিল না; যদিও শুরুতে গোল পেয়েছে। তবে মনে হয় (৭৪তম মিনিটের) পেনাল্টি পাওয়া উচিত ছিল চট্টগ্রাম আবাহনীর।

মাঝমাঠে মামুনুলরা বল ধরতে পারেনি। এফসি পচেয়ন যখন আক্রমণে যায়, তখন ওদের সবাই আশপাশ থেকে ওঠে। আমি একটা বল নিয়ে দৌড় দিলাম, সেক্ষেত্রে আমাকেও আমাদের কাউকে উঠে আসার সুযোগ দিতে হবে। এই সমস্যা কেবল চট্টগ্রাম আবাহনীর নয়, আমাদের সব ক্লাবের ফুটবলের ক্ষেত্রেই।

আপনিও তো দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে খেলেছেন, তফাৎটা?

আশীষ ভদ্র: এফসি পচেয়নও কোরিয়ার ধাচেঁই খেলে। আমার মনে হয়, আমাদের সময় ওরা আরও ভালো খেলত। অ্যাকুরেসি ভালো ছিল। আমাদের বেসিক ভালো না। ওরা জিম করে। ক্রিকেট ও ফুটবলে পাওয়ার ট্রেনিং না করলে, জিম না করলে বাড়তি শক্তিটা আসে না। ফিটনেসটাও ঠিকঠাক থাকে না।

ঘরোয়া ফুটবলের বর্তমান ধাঁচটা কি আপনাদের সময়ের মতো আছে?

আশীষ ভদ্র: না। অথচ আগের চেয়ে এখন সুবিধা অনেক বেশি। ভালো অবকাঠামো আছে, ফিজিও আছে, যেটা আমরা পাইনি। আমাদের সময় ব্যক্তিগত কোয়ালিটি ভালো ছিল। একটা ম্যাচ খেলতে হলে পরিকল্পনা করা দরকার কিন্তু সেটাই ছিল না।

যেমন?

আশীষ ভদ্র: দিল্লি এশিয়ান গেমস খেলতে আমরা কলকাতায় গেলাম বাসে। এরপর ট্রেনে করে দিল্লিতে। পরের দিন খেলা। আমাদের প্রস্তুতি ভালো ছিল। ভারতের সঙ্গে হারলাম কিন্তু মালয়েশিয়ার বিপক্ষে জিতেছিলাম। ওই সময় সঠিক পরিকল্পনা হলে আরও ভালো হতো। শান্টু উচু মানের গোলরক্ষক ছিল। সালাউদ্দিন ভাই দর্শক টেনে আনত মাঠে। (আমাদের তুলনায়) বর্তমান খেলোয়াড়দের অর্জন হয়তো বেশি কিন্তু কোয়ালিটি কম।

কোয়ালিটি না থাকার কারণ?

আশীষ ভদ্র:
পাইপলাইনে ফুটবলার নেই। জুনিয়র স্কুল ফুটবল হচ্ছে না। যারা ট্রেনিং করাচ্ছে, তারাও ততটা ভালো না। বাচ্চাদের ভালো প্রশিক্ষণ হচ্ছে না। একাডেমি চলছে না। সিলেটের একাডেমি বন্ধ। এখন ‘বি’ লিগ করলেন, ২৫ জন ফুটবলার নিয়ে ক্যাম্প করলেন; এভাবে জোসে মরিনিয়োকে আনলেও কিছু হবে না। কিভাবে বাফুফে বলে বিশ্বকাপ খেলবে? এটা দিবাস্বপ্ন!

পাইপলাইনে ফুটবলার না থাকার দায়টা কাকে দেবেন?

আশীষ ভদ্র: এটা সাংগঠনিক ব্যর্থতা। একা কাউকে দোষ দিতে চাই না। ব্যর্থতার মূল কারণ, আমাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ঠিকঠাক কাজ করছে না। অথচ বাফুফেতে মানসম্পন্ন ফুটবলাররা দায়িত্বে। তাদের সম্মান দিয়েই বলছি, তারা তত কাজ করছে না।

কিন্তু আপনাদের সময়ও মানসম্পন্ন কোচ ছিল না। কিভাবে উঠে এলেন?

আশীষ ভদ্র: ওই সময়ে জেলা পর্যায়ে খেলা ছিল। যশোর, খুলনা থেকে অনেক ফুটবলার উঠে আসত। কুমিল্লা, সিলেট সব জায়গাতে খেলা হতো। এখন লিগ হচ্ছে স্বল্প সময়ে, এক মাসে (জেলা পর্যায়ের) লিগ শেষ। এত দ্রুত কিভাবে হচ্ছে? এমনকি ফরম্যাটও মানা হচ্ছে না!

আবার একটু ক্লাব প্রসঙ্গে ফিরি। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাবে ঘরোয়ার তিন দলের খেলার মূল্যায়নে কি বলবেন?

আশীষ ভদ্র: সত্যিকার অর্থে আমরা অনেক নীচে আছি। ১০ বছর আগে যা ছিল, এখনও তাই। উন্নতি হচ্ছে না। যারা খেলছে, তারা তত গোছালো নয়। শুনেছি এই ক্লাব থেকে একজন, ওই ক্লাব থেকে একজন নিয়ে দল সাজিয়েছে। এটা অ্যাথলেটিকস না, যে এটা দৌড় দিলাম ১০০ মিটার, আর জিতে গেলাম। ফুটবল ব্যক্তিগত না, টিম গেম। টিমওয়ার্ক না থাকলে খেলা কঠিন। আমাদের আক্রমণাত্মক ফুটবলার নেই। আগে যেমন সালাউদ্দিন,  এনায়েত, চুন্নু, হালিমরা ছিল। এখন সব আফ্রিকান; বিদেশি। স্থানীয়রাও ততটা ভালো না।

এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় দলেও। বাংলাদেশ এখন নেপাল, ভুটানের কাছে হারে।

আশীষ ভদ্র: এটা দেখতে স্বাভাবিকভাবে খারাপ লাগে। কাল ভালো ম্যাচ হলো অথচ দর্শক আসেনি। আমরা যখন খেলতাম, বিকেল ৪টায় খেলা হত, ১১টায় গ্যালারি ভরে যেত!

সব কিছু দেখেশুনে কি মনে হয়?

আশীষ ভদ্র: যেভাবে চলছে, তাতে আমি কোনো আশার আলো দেখি না। সিলেটে খেলল অনূর্ধ্ব-১৬। ওদের পরিচর্যা করলে ভালো হতো। এগুলো না হলে সঠিক ট্র্যাকে ফেরা যাবে না। তৃণমূল পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

এবার নিজের ক্যারিয়ারের জানা-অজানা নিয়ে একটু বলুন..

আশীষ ভদ্র:
কেকেআরসি থেকে রহমতগঞ্জে ১৯৭৮ সালে। এরপর ঢাকা আবাহনীতে ১৯৮১ সালে যোগ দিলাম। তিন বছর খেলার পর ১৯৮৪ সালে মোহামেডানে যাই। এক মৌসুম পর আবাহনীতে ফিরি। ১৯৯০ সালে হাঁটুতে চোট পাওয়ার পর আর খেলতে পারিনি।

জাতীয় দলের জার্সিতে..

আশীষ ভদ্র: জাতীয় দলে ১৯৭৮ সালে সুযোগ পাই। ঢাকা লিগে খেলি তখন। এশিয়ান গেমসে একাদশে সুযোগ পাই। টানা ১৯৯০ পর্যন্ত ছিলাম। বাদ পড়িনি কখনো।

আপনাকে আবাহনীর আশীষ বলেই জানে সবাই। তো মাঝে মোহামেডানে যাওয়ার কারণটা কি বলবেন?

আশীষ ভদ্র: (হাসি) সিলি ব্যাপার। সেক্রেটারিকে বলছি চলে যাব, টাকা দেন। মজা করেই বলেছিলাম। উনি সিরিয়াস হলেন, আমিও সেন্টিমেন্টাল হয়ে মোহামেডানে গেলাম!

ক্লাব ক্যারিয়ারে কাদের সঙ্গে খেলাটা উপভোগ করতেন?

আশীষ ভদ্র: মাঝমাঠে খোরশেদ বাবুল ও আমার বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। সেসময় একজন আরেকজনের প্রতি আন্তরিক ছিল। টিমওয়ার্ক ভালো ছিল। আবাহনীতে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আবাহনী ছিল পরিবারের মতো। অথচ মোহামেডানের খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে হত!

ওই সময় খেলত বাবুল, জনি, টুটুল পাকির আলী, মনি, চুন্নু, আনোয়ার, সালাউদ্দিন। সোনালী প্রজন্ম। বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম বাবুলের সঙ্গে। আসলাম আমাদের জন্য বেশ কার্যকর ফরোয়ার্ড ছিল। আমি গোলকিপার ও ডিফেন্ডারের মাঝে বল ছেড়ে দিলে ও কানেক্ট করত। ও খুব পাওয়ারফুল স্ট্রাইকার ছিল। হেডিংয়েও ভালো ছিল।

মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথে ফুটবলের পাশাপাশি স্লেজিং কেমন চলত?

আশীষ ভদ্র:
(হাসি) তখনকার সংস্কৃতি বলে বোঝানো যাবে না। মাঠে প্রচুর স্লেজিং হতো। মোহামেডান বেশি করতো। ওটা না করে যদি খেলতো, তাহলে ওরা আরও বেশি ভালো করত। ওটা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেত! ওদের পরিকল্পনায় থাকত, ৫ মিনিট থেকে শুরু করবে স্লেজিং!

এখন তো আর সেই সংস্কৃতি নেই…

আশীষ ভদ্র: এখন এরা পেশাদার। এদের দোষ দিই না। তবে যে যখন খেলবে, শতভাগ দেওয়া উচিত। বাদল দার (বাদল রায়) সঙ্গে খেলা দেখছিলাম সেদিন। মোহামেডান ভালো খেলে না দেখে উশখুশ করছিলেন তিনি।

আপনাকে ধরা হয় সোনালি প্রজন্মের সেরা মিডফিল্ডার। যদি আত্মসমালোচনা করতে বলি...

আশীষ ভদ্র: রানিং খারাপ ছিল। কম দৌড়াতাম। কারণ চেজিং দুর্বলতা ছিল। বাবুলের সঙ্গে খেলতে এ কারণেই মজা ছিল বেশি। ও চেজ করে ক্রিম বলগুলো এনে দিত। আমরা শুধু পাস করতাম। বাবুল ৯০ মিনিটই দৌড়াত। তাতে আমার স্ট্যামিনা নষ্ট হতো না। ও আমাকে অলস বানিয়ে দিয়েছে (হাসি)।

আপনার পর মাঝমাঠে কে কে পছন্দের?

আশীষ ভদ্র: আরমান মিয়া ও রুম্মান ওয়ালী বিন সাব্বির। সাব্বির সে অর্থে মিডফিল্ডার ছিল না; তবে অনেক সময়েই অনেক দলের হয়ে সে ওই পজিশনে খেলেছে।

এই প্রজন্মের?

আশীষ ভদ্র: এখন মামুনুল খুব ভালো খেলোয়াড়। বাঁ পায়ে ভালো খেলে।