ঢাকায় আলির স্মৃতিতে কাতর দুই বক্সার

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮ সাল। সেদিনের সেই কিশোর মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, টগবগে তরুণ আব্দুল হালিম এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন অনেকটা। কিন্তু মুহাম্মাদ আলির সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো দুজনের স্মৃতিপটে এখনও তরতাজা। শুক্রবার না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এই কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধার বাংলাদেশ সফরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গিয়াস, হালিম ফিরে গেলেন কৈশরে, তারুণ্যে ভরা দিনগুলোতে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2016, 01:35 PM
Updated : 4 June 2016, 04:00 PM

একটি বিদেশি সংস্থার প্রচেষ্টায় ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা পা রেখে ২৩ ফেব্রুয়ারি উড়াল দিলেন আলি। এই পাঁচ দিনে ঘুরলেন সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার; জাহাজে চেপে নৌবিহারে গেলেন, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে (সে সময় ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম) প্রদর্শনী মুষ্টিযুদ্ধেও নামলেন আলি। রিংয়ে নেমে মজা করলেন, নিজে হাসলেন, মানুষকে হাসালেন, বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হলেন আলি।

রিংয়ে সেদিন আলির সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধে নামার কথা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিনের জন্য প্রথম হয়ে যাওয়া বক্সার হালিমের। ১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর এটাই প্রথম পদক জয়ের গল্প। কিন্তু আলির কথা, তরুণ নয়, ক্ষুদে প্রতিপক্ষ চাই তার।

শনিবার পল্টনে মুহাম্মাদ আলির নামে রাখা বক্সিং স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে ১৯৭৮ সালে ফিরে গেলেন হালিম।

“তখন আমি টগবগে তরুণ। আলিকে দেখার পর নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বক্সারের সঙ্গে কথা বলছি? তার সঙ্গে খেলব? তার সঙ্গে আমার বক্সিং করার কথা ছিল। কিন্তু উনি বললেন-আমি তো বড় কারোর সঙ্গে করব না। ছোট কাউকে দেন। শুধু মজা করব। তখন গিয়াসকে আনা হলো।”

আলির সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধে নামা হলো না ওই সময়ের ২৩ বছর বয়সী হালিমের কিন্তু ছবি তোলার তৃপ্তি মিলেছিল। আরও মিলেছিল অনাবিল আনন্দে ভেসে যাওয়া টুকরো টুকরো মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকাটা।

“গিয়াসের এক ঘুষিতে আলি পড়ে গেলেন। সেটি ছিল তার অভিনয়। একটি শিশু ও সাধারণ মানুষের মনে আনন্দ দেয়ার জন্য কী করতে হয়, তা তিনি ভালভাবে জানতেন। রিংয়ে ওভাবে কুপোকাত হয়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে আরও বেশি জায়গা করে নেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুললেন। ছবি তোলার সময় ফটো সাংবাদিকদের সঙ্গেও মজা করতে ছাড়লেন না-সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে চাইলে মুখের কাছে ঘুষি নিয়ে সবাইকে বললেন-এবার ছবি তোলো।” 

আলির সঙ্গে রিংয়ে নামা কিশোর গিয়াসউদ্দিন সেদিন কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। তবে বাংলাদেশের জুনিয়র চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তিন রাউন্ডের লড়াই বিনোদনের পসরা মেলেছিল বেশ। আলির না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে বেদনায় ভারি হয়ে উঠল গিয়াসউদ্দিনের কণ্ঠ।

“তার সঙ্গে রিংয়ে নামা জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মানুষ জন্ম নেবে, মারা যাবে জানি। কিন্তু এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না আজ তিনি নেই। তার মতো বক্সার পৃথিবীতে আর আসবে না।”

সেদিন হাজারো ভক্তের সামনে রিংয়ে আলি মজা করতে চাইলেও গিয়াসউদ্দিন ছিলেন ‘সিরিয়াস’। আলির পড়ে যাওয়ার কারণটা তিনি বুঝতে পেরেছেন পরে।

“তখন আমি জুনিয়রে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। তার সঙ্গে তিন রাউন্ড খেলেছিলাম। সে দিনটি আজও মনে পড়ে। তখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। তিনি বক্সিংয়ের বরেণ্য প্রতিভা। সারা বিশ্ব বক্সিং বলতে তাকে বোঝে। তো তার সঙ্গে খেলা আমার জীবনের বিরল ঘটনা। আমি উৎফুল্ল ছিলাম। আনন্দিত ছিলাম। এ অনুভূতি আসলে বলার মতো নয়।”

“দ্বিতীয় রাউন্ডে উনি আমার বক্সিং খেয়ে রিংয়ে পড়ে যান। এটা তিনি কৌতুক করার জন্য করেছিলেন। এটা ছিল খুবই আনন্দের ব্যাপার। তিনি আসলে মানুষকে মজা দেওয়ার জন্যই এটা করেছিলেন।”

আলি মহাব্যস্ত থাকায় ওই পাঁচ দিনে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি গিয়াসউদ্দিন, হালিমের। টিপসও নেওয়ার সুযোগ মেলেনি। কিন্তু গিয়াসউদ্দিনের কাছে ম্যাচের সেই ১২ মিনিট, হালিমের কাছে ছবি তোলার সেই মিনিট পাঁচেক সময়ই এক কথায়-জীবনের সেরা মুহূর্ত।