লেস্টারের শিরোপা জয়ের রহস্য

ফুটবলের যে দর্শনকে অনেকেই ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছেন, পুরানো সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই লেস্টার সিটিকে প্রথমবারের মতো লিগ শিরোপা এনে দিয়েছেন ক্লাওদিও রানিয়েরি।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 04:13 PM
Updated : 3 May 2016, 05:40 PM

অসাধারণ এক অভিযানের পরিসংখ্যান লেস্টারের অতীতে ফিরে যাওয়ার বিস্ময়কর গল্প বলে। বল দখলে না রেখে এবং গতিময় স্ট্রাইকারকে লং-বল দেওয়ার পদ্ধতিতে খেলেই দারুণ এই ইতিহাস গড়ে তারা। এছাড়া অদলবদলের বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে বেশিরভাগ সময় পরিবর্তনহীন দল খেলিয়েছে লেস্টার।

ইউরোপের অন্য প্রায় সব দলের চেয়ে বেশি লং বলে খেলেছে লেস্টার। গড়ে তাদের বল দখল প্রিমিয়ার লিগে অনেক কম ছিল এবং শিরোপা লড়াইয়ে থাকা প্রতিপক্ষদেরর চেয়ে শুরুর একাদশে সবচেয়ে কম খেলোয়াড় পরিবর্তন করে তারা।

সুইহজারল্যান্ডে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্পোর্টস স্টাডিজের (সিআইইএস) ফুটবল অবজারভেটরিরর গবেষক দলের গত মাসের প্রতিবদনে বলা হয়, রানিয়েরির দল এ মৌসুমে ইউরোপের বড় পাঁচটি লিগে খেলা দুটি দল ছাড়া বাকি সবার চেয়ে বেশি লং বল খেলেছে।

গবেষণায় লেস্টারের ৬.৯ শতাংশ পাসকে লং বল হিসেবে ধরা হয়। জার্মানির বুন্দেসলিগার পয়েন্ট তালিকার মাঝামাঝি থাকা ডার্মস্টাট (১০.৭ শতাংশ) ও ইনগোলস্টাটই (১০.৭ শতাংশ) কেবল তাদের চেয়ে বেশি লং বলে খেলেছে।

এই কৌশল ইউরোপের অন্য বড় চারটি লিগের শীর্ষে থাকা দল বায়ার্ন মিউনিখ, পিএসজি, বার্সেলোনা আর ইউভেন্তুস নেয়নি। এই দলগুলোর লং বল খেলার হার ১.১ থেকে ১.৬ শতাংশের মধ্যে।

স্ট্রাইকার জেমি ভার্ডির গতিকে লক্ষ্য করতে লং বলে খেলার পদ্ধতি লেস্টার খুব নির্দয়ভাবে কাজে লাগায়। গত সোমবার ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এফডব্লিউএ) ভোটে বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হওয়া ভার্ডির ২২ গোল লেস্টারকে শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা রাখে।

এ মৌসুমে লিগ ম্যাচগুলোয় গড়ে লেস্টারের বল দখল ৪৫.৪ শতাংশ। এসটিএটিএস-এর হিসেব অনুযায়ী প্রিমিয়ার লিগে গড়ে এর চেয়ে কম বল দখল আছে শুধু সান্ডারল্যান্ড আর ওয়েস্ট ব্রমের।

বিপরীতে শিরোপা লড়াইয়ে লেস্টারের প্রতিপক্ষদের বল দখলে রাখার হার অনেক বেশি ছিল। প্রায় ৫৬ শতাংশ নিয়ে বলের দখল রাখে আর্সেনাল। ম্যানচেস্টার সিটি (৫৫.২), ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (৫৫.১) আর টটেনহ্যাম হটস্পারও (৫৪.৭) এ ক্ষেত্রে খুব বেশি পিছিয়ে নেই।

লেস্টারের বেশিরভাগ প্রতিদ্বন্দ্বীরই বড় স্কোয়াড ছিল। রানিয়েরির দল এও দেখিয়েছে যে, অদলবদল আধুনিক ফুটবলের অর্থহীন একটি শব্দ মাত্র, এটা শিরোপা চ্যালেঞ্জের জন্য অবশ্যই পূরণীয় পূর্বশর্ত নয়।

৩৫ ম্যাচ শেষে শুরুর একাদশে লেস্টারের ব্যবহার করা খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র ১৮ জন, যা টটেনহ্যামের চেয়ে দুজন কম। আর্সেনাল ব্যবহার করে ২৩ জন খেলোয়াড়। ম্যানচেস্টার সিটি ২২ ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২৬ জন করে খেলোয়াড় ব্যবহার করে।

গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত লেস্টারের ৭ জন খেলোয়াড় ৩২ বা এর চেয়ে বেশি ম্যাচে শুরুর একাদশে খেলে। টটেনহ্যামের ক্ষেত্রে এই খেলোয়াড়ের সংখ্যাটা ৪, আর্সেনালের দুজন এবং সিটি আর ইউনাইটেডের একজন করে।

মৌসুমের শুরুতে ইপিএলের শিরোপা লড়াইয়ে লেস্টারের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে বাজির দর ছিল ৫০০০:১। রানিয়েরির কৌশলে বাজি ধরার প্রতিষ্ঠান আর ফুটবল বিশেষজ্ঞদের সব হিসেব পাল্টে দিয়ে সাফল্যের চূড়ায় বসল লেস্টার।

২০১৫ সালের ২১ মার্চ টটেনহ্যামের কাছে ৪-৩ গোলের হারে প্রিমিয়ার লিগে টানা জয়হীন থাকার সংখ্যাটা সাতে গিয়েছিল লেস্টারের। আর এটা তাদের ৯ ম্যাচ বাকি থাকতে নিরাপদ অঞ্চল থেকে ৭ পয়েন্ট দূরে ঠেলে দেয়।

অ্যান্ডি কিংয়ের শেষ মুহূর্তের গোলে ওয়েস্ট হ্যামকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় লেস্টার। সেই থেকে পেছন ফিরে তাকায়নি তারা।

গত মেতে যেখানে শেষ করেছিল, এবারের মৌসুমটা লেস্টার ঠিক সেখান থেকেই শুরু করে। সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচটি ৪-২ গোলে জেতে, এটা তাদের প্রথম রাউন্ডেই পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে নিয়ে যায়।

টটেনহ্যাম ও বোর্নমাউথের সঙ্গে টানা দুটি ড্রয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে যাওয়ার আগে দুই সপ্তাহ তারা শীর্ষে থাকে। পয়েন্ট তালিকায় তাদের পতনের শুরু এটাকেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি।

বাস্তবতা হচ্ছে, পুরো মৌসুমে লেস্টার ষষ্ঠ স্থানের নিচে নামেনি এবং গত জানুয়ারিতে টটেনহ্যামের বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ে আবার শীর্ষে ওঠার পর এই অবস্থান হারায়নি তারা।

দুর্দান্ত ফর্ম ২ ম্যাচ বাকি থাকতেই তাদের শিরোপা জয় নিশ্চিত করে। কিন্তু শেষ দুটি ম্যাচ জিতলেও গত পাঁচবারের শিরোপা জয়ীদের চেয়ে কম পয়েন্ট পেয়ে লিগ জিতবে তারা।

২০১১-১২, সিটি, ৮৯ পয়েন্ট

২০১২-১৩, ইউনাইটেড, ৮৯ পয়েন্ট

২০১৩-১৪, সিটি, ৮৬ পয়েন্ট

২০১৪-১৫, চেলসি, ৮৭ পয়েন্ট

২০১৫-১৬, লেস্টার, ৭৭ (৩৬ ম্যাচে)

লেস্টারের এই সাফল্য আসে মূলত ভার্ডি আর পিএফএর বর্ষসেরা খেলোয়াড় রিয়াদ মাহরেজের কল্যানে, যারা নিজেদের ভয়ানক এক জুটি হিসেবে প্রমাণ করেছে, বিশেষ করে গোল করার ক্ষেত্রে।

লেস্টারের গোলদাতারা:

জেমি ভার্ডি: ২২

রিয়াদ মাহরেজ: ১৭

লিওনার্দো উলোয়া: ৬

শিনজি ওকাজাকি: ৫

লেস্টারের গোলে শীর্ষ সহায়তাকারীরা:

রিয়াদ মাহরেজ: ১১

ড্যানি ড্রিঙ্কওয়াটার: ৭

জেমি ভার্ডি: ৬

মার্ক আলব্রাইটন: ৬