নিরাপদ ইন্টারনেট: আলোচনা শুরু হোক

আজকের দিনে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের কথা যখন ওঠে, তখন মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) কথাই বোঝানো হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2015, 12:23 PM
Updated : 30 August 2015, 03:01 PM

প্রতিদিন নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের হাতে আসছে, সেই সঙ্গে তামাদি হয়ে যাচ্ছে পুরনো উদাহরণগুলো। ‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ’কে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। 

বার্গলার অ্যালার্মের কল্যাণে অনেক শহরের মানুষ আজ সিঁধেল চুরির কথা ভুলেই গেছে।

ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা অনেক সমস্যার সমাধান করেছে, কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন অনেক সমস্যার। অপরাধ ঠেকাতে ‘নজরদারি’ সহায়ক হয়েছে, কিন্তু কাজ করছে দমনের হাতিয়ার হিসেবেও।   

নিরাপত্তার নামে বসানো এসব ক্যামেরার নজরদারি আমাদের অনেকের জীবনেই বড় ধরনের বিড়ম্বনার জন্ম দিচ্ছে। নাগরিক অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই এ বিষয়টিকে দেখছেন সাধারণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হিসেবে।

এসব ক্যামেরা কখনো কখনো এমন ছবিও তুলছে, যা তোলার অধিকার আইনে দেওয়া হয়নি। আমাদের বাংলাদেশের সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। কয়েক বছর আগে পারসোনার বিরুদ্ধে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ব্যবহার করে সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে, যা সে সময় সংবাদের শিরোনাম হয়।

যেসব দেশে মানুষের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি, সেখানেও গাড়ি চুরির ঘটনা একসময় নৈমত্তিক বিষয় ছিল। 

এরপর এল নতুন নতুন প্রযুক্তি। অ্যালার্ম, ট্র্যাকিং ডিভাইস, মালিকের আঙুলের ছাপ চিনতে পারে এমন চাবি...। এছাড়া চুরি যাওয়া গাড়ি খুঁজে বের করতে বা এর অবস্থান সনাক্ত করতে কাজে লাগে, এমন নানা প্রযুক্তি এল।     

কিন্তু যিনি প্রযুক্তির পোকা নন, আইনবিদ বা আইনপ্রয়োগকারীও নন- যিনি কেবলই একজন সাংবাদিক বা প্রকাশক, তার সামনে প্রযুক্তিনির্ভর এসব অপরাধের এসব ঘটনা আসে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। দুটি বিষয়কে বোধগম্যভাবে এক জায়গায় আনতে আমাকে হয়তো কোনো সহকর্মী বা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে হয়, যিনি এসব বিষয়ে আগ্রহ বা সম্যক ধারণা রাখেন।   

এর উদাহরণ দিতে গিয়ে আমার মনে পড়ছে রামুর ঘটনার কথা, যেখানে বৌদ্ধ বসতি ও মন্দিরে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল ধর্মাবমাননার অভিযোগ তুলে। 

ওই ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্বকে তা জানাতে আমার সহকর্মীরা সে সময় রাত জেগে কাজ করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তখন দেশের বাইরে, নিউ ইয়র্কে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে। সেখান থেকেই তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন, দোষীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করতে বললেন।

কিন্তু ঠিক কীভাবে সেই সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা ওই মুহূর্তে কেউ দিতে পারছিলেন না। পরে জানা গেল, এক ব্যক্তির ফেইসবুক পৃষ্ঠায় এমন কিছু পোস্ট করা হয়েছিল, যা ধর্মান্ধদের উস্কে দিয়েছে।পরে নিশ্চিত হওয়া গেল, ওই নামে বাস্তবে একজনের অস্তিত্ব থাকলেও সেই ফেইসবুক পৃষ্ঠাটি তার নয়। সেটি তৈরি করেছিলেন অন্য কেউ; আর ওই ঘটনা সাইবার স্পেসের সুবিধা ব্যবহার করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

এরপর ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের কথাও কি কোনোভাবে ভোলা সম্ভব?

তিনি নাস্তিক, তিনি ধর্মাবমাননাকারী, ব্লগে তিনি নবীর অবমাননা করেছেন- এমন বহু কথা তাকে নির্মমভাবে হত্যার পর ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এসব বিষয় অনুসন্ধান করে আমার এক সহকর্মী দেখিয়েছেন, একটি ব্লগ সাইট রাজীবের বলে চালানো হচ্ছিল যা আদৌ তার নয়। আর সেখানে বিভিন্ন পোস্ট তোলা হয়েছিল রাজীব খুন হওয়ার পর।

অর্থাৎ, ভয়ঙ্কর অভিসন্ধি মাথায় নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই সব ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে যা করেছে, তা হচ্ছে অপরাধ।

হ্যাকিং

গত বছর চীনে অ্যাপল ইনকপোরেটের আইক্লাউড স্টোরেজ সেবা হ্যাকারদের কবলে পড়ে। চীনের একটি ওয়েব মনিটরিং গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, হ্যাকাররা আইক্লাউড ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির চেষ্টা করেছিল।

হ্যাকিংয়ের এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ম্যান-ইন-দ্য-মিডল অ্যাটাক’ বা এমআইটিএম। এতে হ্যাকাররা অ্যাপলের আইক্লাউড সার্ভার ও ব্যবহারকারীদের মাঝখানে নিজেদের ওয়েবসাইট বসিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তারা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, আইমেসেজ, ছবি, যোগাযোগের ঠিকানা, এমনকি পাসওয়ার্ডও জেনে ফেলতে পারে বলে এক ব্লগ পোস্টে লিখেছে গ্রেটফায়ার ডট অর্গ।

প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং তথ্য চুরির একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এটি। আইক্লাউড অ্যাকাউন্ট চালানোর ক্ষেত্রে সতর্ক না হলে বিপদে পড়তে পারেন যে কেউ। চীনের ওই ঘটনা যখন আলোচনায়, সে সময় বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটিকে সতর্ক না হওয়ার জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।

প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের সংজ্ঞায়ন

প্রযুক্তি ও অপরাধের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি প্রতিদিন নতুন নতুন মাত্রা নিয়ে আমাদের সামনে আসছে। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের সংজ্ঞায় কী কী অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত- সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা  স্বাভাবিকভাবেই একমত হতে পারেননি।

অনেকের মতে, কেবল কম্পিউটার ব্যবহার করে অপরাধই সাইবার ক্রাইমের আওতায় পড়বে। ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক, ভার্চুয়াল স্পেস ও হ্যাকিংয়ের মত বিষয়গুলো এর মধ্যে পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের আরেকটি পক্ষ বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে দেখার পক্ষে। তাদের মতে, কম্পিউটার বা প্রযুক্তির ব্যবহার হলেই তাকে এ ধরনের অপরাধের সংজ্ঞায় ফেলা যায়।

সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় বোঝার সুবিধার জন্য প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধগুলোকে আলাদা ভাগে বিন্যস্ত করারও চেষ্টা হয়েছে। অতি বুদ্ধিমান অপরাধীদের হাতে এ অপরাধের ধরন প্রতিনিয়ত বদলে যেতে থাকলেও তাদের হাতকড়া পড়ানোর চেষ্টায় থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ধরনের সব অপরাধকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করেছে। 

এর মধ্যে এক ভাগে রাখা হয়েছে সেই সব অপরাধকে, যেগুলো কম্পিউটার ব্যবহার না করে করা সম্ভব না। ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক ও ডিজিটাল তথ্যের ব্যবহার যত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে নতুন ধরনের অপরাধ সংঘটনের সুযোগ। নতুন এই ‘ভার্চুয়াল জগতের’ বিশেষ কিছু দুর্বল জায়গা রয়েছে, যা কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা।

গোপনে কোনো কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশ, ডিজিটাল তথ্যে পরিবর্তন আনা এবং ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্কে হ্যাকিং এ ধরনের অপরাধের মধ্যে পড়ে। এসব অপরাধ ঘটিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব।

অন্য ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধগুলোকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় ভাগে।

নতুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার পাশাপাশি আধুনিক সমাজকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।প্রায় সব ধরনের অপরাধে এখন প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব। যেমন ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেওয়া এখন অনলাইনে সম্ভব হচ্ছে। ধর্মীয় নেতা ও অসৎ রাজনীতিবিদরা এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে উসকানি দিতে পারেন। আরও আছে ‘সাইবারবুলিং’, মানুষকে হেনস্তা করার মতো ঘটনা।

এসব নতুন প্রযুক্তি অপরাধীদের সামনে এনে দিচ্ছে নতুন কায়দায় অপরাধ সংঘটনের সুযোগ। পুরনো অপরাধগুলো নতুন মোড়ক পাচ্ছে, আবার পুরো নতুন ধারণার অপরাধও চমকে দিচ্ছে আমাদের।

দৃশ্যত অসীম ‘সম্ভাবনার’ এক জগত তৈরি করছে এই তথ্যপ্রযুক্তি।প্রথমত, ইন্টারনেটে নিজের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ নতুন একদল অপরাধী তৈরি করছে, যারা এই সুযোগ না পেলে হয়তো এসব অপরাধে জড়াত না। এই অপরাধীদের মধ্যে তারাও রয়েছেন, যারা সরাসরি অন্যপক্ষের কম্পিউটার বা তথ্যভাণ্ডারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন; এরা হ্যাকার।

দ্বিতীয়ত, অপরাধীদের একটি অংশ এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তাদের অপরাধকে আরও নিখুঁত করার কাজে। তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের লাভ আর দক্ষতা বাড়িয়ে নিচ্ছে, কমিয়ে আনছে ঝুঁকি।

এই সুযোগে কিছু অপরাধী তাদের সনাতনি ধরন বদলে পুরোপুরি সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়। 

উন্নত বিশ্বে যারা অপরাধ নির্মূলে কাজ করছেন, তারা প্রচলিত অপরাধ এবং প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের পার্থক্য চিত্রায়িত করেছেন এভাবে-

প্রচলিত বনাম প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ

প্রচলিত অপরাধের ভার্চুয়াল সংস্করণে অপরাধীদের বিভিন্ন দিক দিয়ে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে:

১. অপরাধ করার জন্য অপরাধীদের আর সশরীরে হাজির থাকতে হয় না।

২. অপরাধ সংঘটনে সীমান্ত আর বাধা নয়।

৩. কম্পিউটারের সুবিধা নিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধ ঘটানো যায়, ক্ষতি করা যায় একসঙ্গে অনেক মানুষের। অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করার কাজটিও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

প্রচলিত বনাম ভার্চুয়াল চাঁদাবাজি 

প্রচলিত অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অপরাধীদের হাত থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে নগদ টাকায় চাঁদা দিতে বাধ্য হন। প্রযুক্তির কারণে বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে এসব অপরাধীরা এখন অনলাইনে কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানকেও ভার্চুয়াল হামলা থেকে বাঁচতে চাঁদা বা টাকা দিতে বাধ্য করছে।

ডাকাতি বনাম হ্যাকিং

প্রচলিত কায়দায় ব্যাংক বা টাকার ভ্যান থেকে অর্থ লুট করে ডাকাতরা। কিন্তু আজকাল অপরাধীরা ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করে ইলেকট্রনিক পেইমেন্ট সিস্টেমে টাকা পাঠিয়ে লুটের কাজটি সারে।

ক্রেডিট কার্ড চুরি বনাম অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি

প্রচলিতভাবে, অপরাধীরা লোকজনের ফেলে দেওয়া ক্রেডিট কার্ডের স্টেইটমেন্ট বা ইউটিলিটি বিল হাতিয়ে নিয়ে সেগুলো থেকে তাদের পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা করে। আর এখন সাইবার অপরাধীরা কোনো কোম্পানির তথ্যভাণ্ডার হ্যাক করে একসঙ্গে হাজার হাজার ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চুরি করতে পারছে।

‘বয়লার রুম’ শেয়ার ঠকবাজি বনাম ‘পাম্প অ্যান্ড ডাম্প’ শেয়ার ঠকবাজি

পশ্চিমা ঘরানার অপরাধের একটি নমুনা এটি।প্রচলিত কায়দায় অপরাধীরা নিজেদের ব্রোকার পরিচয় দিয়ে টেলিফোনে কৃত্রিমভাবে বাড়ানো দামে কোম্পনির শেয়ার বিক্রি করত। আজকাল সাইবার অপরাধীরা কোম্পনির শেয়ার কিনে লোভনীয় কিন্তু ভুয়া আর্থিক স্টেইটমেন্ট দেখিয়ে সেই শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে, তারপর তা বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

ভুয়া ফোন কল বনাম ফিশিং

প্রচলিতভাবে অপরাধীরা ব্যাংকের প্রতিনিধি সেজে ফোন করে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়। আর এখন সাইবার অপরাধীরা অনুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে একই রকম দেখতে ইমেইল পাঠাচ্ছে এবং ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে।

সিঁধেল চোর বনাম ম্যালওয়্যার ও কম্পিউটার ভাইরাস

প্রচলিত কায়দায় চোরেরা একজন গিয়ে বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে মালিককে বিভ্রান্ত করে এবং আরেকজন পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়। সেই একই কায়দা ব্যবহার হচ্ছে অনলাইনে। শিকারের কম্পিউটারে পাঠানো হচ্ছে ম্যালওয়্যার, পরে সেই কম্পিউটার আক্রান্ত হচ্ছে ভাইরাসে।

এখানে আমরা কিছু শব্দ পাচ্ছি যা স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে হয়নি এমন অপরাধের ধরন বুঝতে সাহায্য করে। সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইলিং, প্রতারণা, চৌর্যবৃত্তি ও ভীতিপ্রদর্শন– এগুলোর সবই ফিশিং বা ম্যালওয়ারের মাধ্যমে করা সম্ভব, যাকে আইনি বচনে প্রায়ই কম্পিউটার-দূষক ও ব্যাডওয়্যার বলা হয়। বাহ্যিক দর্শনে এসব সফটওয়্যার নিরীহ বলে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলো বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এখানে আরও একটি বিষয় আছে, যাকে বলা হয় ক্লিক ফ্রড। অনলাইন বিজ্ঞাপনে প্রতি ক্লিকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতারণা করা হয়। সম্ভবত বাংলাদেশে এ প্রতারণার সবচেয়ে বড় শিকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দেখার জন্য নয়, ক্লিক বাড়ানোর জন্য অটোমেটেড স্ক্রিপ্ট বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হয়। ক্লিক ফ্রডের বিষয়টি ইতোমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং এ নিয়ে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। এ থেকে বিজ্ঞাপনী নেটওয়ার্কগুলো প্রধানত লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত একটি সংবাদপত্রও এ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, বেশ কয়েকবার গুগল ওই সংবাদপত্রটি নিষিদ্ধ করেছে। তারা ঘন ঘন তাদের ডোমেইন নাম বদলে ফেলে এবং সাইটটি লোড হওয়ার সময় ওই ওয়েব ঠিকানা ব্যবহারকারীকে নিয়ে যায় ওই প্রতিষ্ঠানের মূল ঠিকানায়।

কুকি

কুকি ভাইরাস বহন করে না; কম্পিউটারে ম্যালওয়্যারও ইনস্টল করতে পারে না। তবে ট্র্যাকিং কুকিগুলো, বিশেষ করে থার্ড-পার্টি ট্র্যাকিং কুকিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত ব্রাউজিংয়ের ইতিহাস পাচার করতে পারে। এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ঝুঁকিতে পড়ে বলে চার বছর আগেই ইউরোপীয় ও যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হন।

এসব কুকি কম্পিউটার ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড এবং কখনো কখনো তার ফরম পূরণের সময় দেওয়া তথ্য, যেমন ব্যাংক কার্ড নম্বার বা ঠিকানাও সংগ্রহ করে। যখন একজন ব্যবহারকারী প্রথমবারের মতো একটি ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন, সার্ভার থেকে তার কম্পিউটারের ব্রাউজারে একটি কুকি পাঠানো হয়। সেই কুকি ব্যবহারকারীর দেওয়া তথ্য সঞ্চয় করে রাখে। আবার কখনো তিনি ওই ওয়েবসাইটে গেলে কুকির তথ্য থেকেই সেই সার্ভার ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করতে পারে।

একজন সাইবার অপরাধী যখন কাউকে ফেইসবুকের মাধ্যমে হুমকি দেয়; ব্লগার রাজীবের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, সেভাবে কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় এবং হত্যার পরিবেশ তৈরি করে; রাষ্ট্রের মৌল নীতির বিরুদ্ধে বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিছু ঘটায় কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিংসা ছড়িয়ে দেয়- এর সবগুলো অপরাধই সূদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল: প্রযুক্তির সহায়তায় বলিয়ান এইসব অপরাধীর বিরুদ্ধে আমরা লড়ব কীভাবে?

ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করে কিংবা ফায়ারওয়াল বসিয়ে সুরক্ষা পাওয়ার চেষ্টা এক ধরনের প্রযুক্তিগত সমাধান হতে পারে। সেই সঙ্গে চলতে পারে নজরদারি এবং আপরাধের বিরুদ্ধে প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের কাজ।

কয়েক বছর আগে মাদ্রিদে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যখন বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হল, তখন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নতুন কড়াকড়ি আরোপ করল।বলা হল, ব্যবহারকারীদের সমস্ত তথ্য অন্তত এক বছরের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।

তবে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব ব্যবহারকারীদের সচেতন করে তোলার মাধ্যমে। সাইবারবুলিংয়ের তথ্য দিয়ে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ কিছুটা সহজ করে দিতে পারে।

সম্ভাব্য অপরাধীদের যে কোনো অনলাইন তৎপরতার রেকর্ড রাখতে হবে। ইমেইল, ওয়েব ঠিকানা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট তারিখ ও সময়সহ রেকর্ড রাখা দরকার। ইলেকট্রনিক সংস্করণ (স্ক্রিনশট) এবং ছাপা কপি- দুভাবেই এই রেকর্ড সংরক্ষণ করা জরুরি।

সম্ভব হলে নিজের সুবিধা অনুযায়ী প্রাইভেসি ও সিকিউরিটি সেটিং বেছে নিতে হবে। কার সঙ্গে কতটুকু তথ্য বিনিময় করতে চান, তার সীমা নিজেকেই ঠিক করে দিতে হবে।

আচরণে হতে হবে দায়িত্বশীল। কেবল তাদের বিষয়েই অনলাইনে পোস্ট করা উচিৎ, যারা আমার সম্পর্কে পোস্ট দিলে আমার আপত্তি থাকবে না।

মনে রাখতে হবে, এই সাইবার সমাজে আমাদের প্রতিটি আচরণ আমাদের বাড়িতে, আমাদের কর্মক্ষেত্রে, এমনকি পুরো ডিজিটাল বিশ্বের অন্যদেরও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।

আসুন, আমরা আলোচনাটা চালিয়ে যাই।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী: প্রধান সম্পাদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

নিবন্ধটি ২০১৪ সালের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগে দেওয়া তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বক্তৃতার উপর ভিত্তি করে তৈরি।