‘কোপ খেয়ে পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়’

অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হওয়ার পর প্রতিবাদ আর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে ফেইসবুকেও।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিইব্রাহীম খলিল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2016, 04:49 AM
Updated : 25 April 2016, 04:56 AM

সহকর্মী, শিক্ষার্থী, আরও অনেকের বিক্ষোভের লেখনীতে এসেছে প্রতিরোধের ডাক, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ নিয়ে অসন্তোষ। 

এর আগে গত এক যুগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যার শিকার অন্য তিন শিক্ষকের কথাও বার বার ফিরে আসছে।   

গত শনিবার ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম নিহত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ ফেইসবুকে লিখেছেন, “স্যারের রক্তাক্ত ছবিটাও দেখলাম মাত্র। নীলচে কালো প্যান্ট, শাদা শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। পাশেই পড়ে আছে ব্যাগটা। মনে হলো ঘাড় থেকে গলা পর্যন্ত কোপ খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।”

তিনি প্রশ্ন রেখেছেন- “এইভাবে খুন-হওয়াদের সাথে নিজেদের অমিল খুঁজে-খুঁজে বাঁচা মানুষেরা এখন কী করবে?”

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন, “ঘাড়ের শিরাগুলো ক্রমাগত দপদপ করে চলেছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে। মনে হচ্ছে, যে কোনো রক্তক্ষরণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। 'মিনমাম কমন গ্রাউন্ডে' দাঁড়াতে হবে। আমরা কোনো ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু চাই না। অন্তত এইটুকু গ্যারান্টি চাই।...”

‘সেই নিশ্চয়তা কি রাষ্ট্র দিতে পারে না’-  প্রশ্ন রেখেছেন এই শিক্ষক।

একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটনের প্রতিক্রিয়ায় ঝরেছে শ্লেষ।

এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী (ফাইল ছবি)

“আমরা আমাদের চোখ আপাতত রাষ্ট্রের কাছে জমা দিয়েছি। আমরা কোনো খুনখারাবি দেখব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাষ্ট্র যা দেখাবে দেখব। রাষ্ট্রের তরফে মিডিয়া যা শোনাবে শুনব। আট-সকালে আরকেএস কোপ খেলেন ঘাড়ে। স্মুদ কোপ। শেখা হাতের কোপ। দেখল না কেউ। সবাই শুনেছেন শুধু। আরকেএসের খুন একটা শোনা-কথা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু কোপ খাওয়া লাশটা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল যে! সেটা সবাই দেখেও ফেলেছেন। কি মুশকিল!”

ঘাতকের চাপাতিতে আরেক শিক্ষককে হারিয়ে ফেইসবুক বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন শিক্ষকরাও।নিজের প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করে অধ্যাপক রেজাউল করিমের ছবি দিয়েছেন কেউ কেউ। শেয়ার করছেন পুরনো ছবি, বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতি।

আবদুল্লাহ খান বাদল নামে এক পুলিশ পরিদর্শক ফেইসবুকে লিখেছেন, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে এবং নির্বিঘ্নে কুপিয়ে হত্যা মনে হয় খুবই সহজতর মজার কাণ্ড!!!! ... পরিচিত এবং অপরিচিত সবাইকে নিয়ে শঙ্কিত, জানি না এরপর কে??”

এর আগে ২০১৪ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শফিউল ইসলাম, ২০০৬ সালে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যার এস তাহের আহমেদ এবং ২০০৪ সালে অর্থনীতির ড. ইউনুস খুন হন।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস অধ্যাপক রেজাউল হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী এক ওয়েবসাইট। পুলিশও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কথা বলেছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক শিবির নেতাকে।

কিন্তু শিক্ষক রাজনীতি থেকে ‘দূরে থেকে’ অধ্যাপনা, সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মেতে থাকা ‘শান্তিপ্রিয়’ মানুষ হিসেবে পরিচিত রেজাউল করিমকে কেন হত্যা করতে হলো- তার জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। 

ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মোজাফফর হোসেন তার শিক্ষককে স্মরণ করে লিখেছেন, “তার কোনো ব্লগ বা ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল না। অল্প কিছু কবিতা, ছোটগল্প আর চলচ্চিত্র রিভিউ লিখেছেন। বিশেষ কোনো পত্রিকাতে সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। তার কোনো লেখা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক না। সামাজিক বক্তব্যধর্মী লেখা লিখতেন। টিজেন কেইন, বাইসাইকেল থিফ, পথেরপাঁচালি-চোখের বালি-মেঘে ঢাকা তারা, অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, সিন্ডলার্স লিস্ট- এসব ক্লাসিক ছবি নিয়ে লিখেছেন। তাহলে এভাবে নির্মমভাবে খুন করা হল কেন?”

আর শিক্ষার্থী মাহবুবা জাহানের লেখায় এসেছে সতর্কবার্তা। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন- এভাবে চলতে থাকলে কেউ আর নিরাপদ নয়।  

“দাঁড়িয়ে রইব রাস্তার পাশে, তীব্র বেগে ধেয়ে আসবে মোটর বাইক, অসম্ভব দ্রুততায় ধারালো চাপাতি ছুড়ে দেবে যুবক আমার ঘাড় বরাবর। কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ব সাথে সাথেই, নিজের রক্তে বানানো ছোটখাট পুকুরে। শেষবারের মত আকাশ দেখার জন্য তাকাব খোলা চোখে, উপরে, এবং তাকিয়েই রইব ... ভাববেন না, আমার জায়গায় আপনিও হতে পারেন!”