‘আন্তঃনাক্ষত্রিক যাত্রা’য় সমর্থন হকিংয়ের

এক প্রজন্মের মধ্যে সৌরজগতের বাইরের কোনো নক্ষত্রের কাছে পৌঁছে যেতে পারে এমন ক্ষুদ্রাকৃতির মহাকাশযান পাঠানোর একটি প্রকল্পে সমর্থন জানিয়েছেন খ্যাতিমান পদার্থবিদ স্টিভেন হকিং।

মীর মোশাররফ হোসেন বিবিসি অবলম্বনেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2016, 03:22 PM
Updated : 13 April 2016, 03:22 PM

প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার চিপের সমান আকারের ‘স্টারশিপ’ মহাকাশযান মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে সৌরজগতের বাইরের নিকটতম নক্ষত্রের সীমানায় পৌঁছে যাবে, পাঠাবে ছবি ও তথ্য।

রুশ ধনকুবের ইউরি মিলনারের প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রেকথ্রু ফাউন্ডেশন’র ১০০ মিলিয়ন ডলারের এই আন্তঃনাক্ষত্রিক যাত্রা শুরুর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আর এতে হকিং ছাড়াও ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ যুক্ত আছেন বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নক্ষত্র ভ্রমণ করতে পারে এমন মহাকাশযান বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকেই, কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতায় সেই স্বপ্ন কখনোই সামনের দিকে এগোয়নি।

হকিং বলেন, “রূপকথার সেই ভাবনা বাস্তবের মুখ দেখতে পারে শিগগিরই। আমরা যদি প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে চাই, আমাদের অবশ্যই সৌরজগতের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে হবে

“জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন, আলফা সেনচাউরি সিস্টেমে ঘুরছে এমন একটি গ্রহ পৃথিবীর মত হতে পারার বাস্তবভিত্তি আছে। আমরা অবশ্য আগামী দুই দশকের মধ্যেই স্থলভিত্তিক ও মহাকাশভিত্তিক টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আরও অনেক কিছু জানতে পারব।”

সৌরজগতের বাইরে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রমণ্ডলীর দূরত্ব পৃথিবী থেকে অন্তত ৪০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। বর্তমান প্রযুক্তি ও মহাকাশযানে এ দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগবে কম করে হলেও ত্রিশ হাজার বছর।

তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, কয়েকটি বিষয়ে কিছু গবেষণা এবং উন্নয়ন হলে যাত্রার সময় ৩০ বছরে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। আর এজন্য সৌরজগৎ পাড়ি দেওয়া মহাকাশযানটির আকার অবশ্যই কম্পিউটার চিপের মতো ছোট হতে হবে।

প্রযুক্তির ‘গত দুই দশকের অগ্রযাত্রা এবং ভবিষ্যৎ’ দুইয়ে মিলে আগামী এক প্রজন্মের মধ্যে এ বিষয়ে সফলতা আসবে বলে ধারণা পদার্থবিজ্ঞানী হকিংয়ের।

এবার প্রাথমিক গবেষণা শেষে বিজ্ঞানীদের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়েই ইউরি মিলনার এ ‘মহা-প্রকল্প’ হাতে নেন, যাতে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন জাকারবার্গ ও হকিং।

স্টিভেন হকিং।

মিলনারের ব্রেকথ্রু ফাউন্ডেশন এর আগে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের একটি দলকে সৌরজগতের বাইরে গিয়ে তথ্য ও ছবি পাঠাতে পারে এমন একটি মহাকাশযান ‘বানানো সম্ভব কী না’ তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছিল।  

এবারা তারা চিন্তা করছে, চিপ-আকৃতির হাজার হাজার ছোট মহাকাশযান তৈরি করে তা পৃথিবীর কক্ষপথে ছেড়ে দেওয়া হবে।

এসব মহাকাশযানের প্রত্যেকটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে একটি করে ‘সৌর পাল’। এ পালে বাতাসের পরিবর্তে আলোর ক্রমাগত ধাক্কাই ক্ষুদ্রাকৃতির মহাকাশযানটিকে সামনে এগিয়ে নেবে।

তবে এর আগে পৃথিবী থেকে লেজার রশ্মির এক ‘শক্তিশালী ধাক্কা’ মহাকাশযানগুলোকে আলোর গতির প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ অর্থ্যাৎ সেকেন্ডে ১৫ হাজার কিলোমিটার গতি এনে দেবে।

ব্রেকথ্রু’র এ পরিকল্পনাকে কল্পবিজ্ঞান মনে হলেও ইউরি মিলনারের বিশ্বাস, তাদের মহাকাশযান ‘জীবদ্দশাতে’ই অন্য নক্ষত্রে পৌঁছে যাবে।

“মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে একটি বড় উল্লম্ফনের। ৫৫ বছর আগে ইউরি গ্যাগরিন প্রথম মানুষ হয়ে মহাকাশে পৌঁছেছিলেন। আর আজ আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি আরেকটি অসাধারণ উল্লম্ফনের, অন্য এক নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে,” বিবিসিকে বলেন মিলনার।

বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, চিপ-সদৃশ এ মহাকাশযানে উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি ও সেন্সর বসাতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হবে। এছাড়া একে শক্তিশালী লেজার রশ্মির ধাক্কা ‘কয়েক মিনিট ধরে সামলানোরও দক্ষতা’ থাকতে হবে; থাকতে হবে ছবি ও তথ্য উদ্ধার করে তা পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর উপায়ও।

সাররে স্পেস সেন্টারের গবেষক ও সাররে স্যাটেলাইট টেকনোলজির প্রধান অধ্যাপক স্যার মার্টিন সুইটিং পুরো বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত কঠিন’ বলে মন্তব্য করেছেন।

“এট শুনতে পাগলামি মনে হতে পরে, কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নে যে কোনো কিছু সম্ভব। এটি এখন আর পাগলামি নয়, তবে কঠিন।”

১৯৮০ সালে মার্টিনের প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি মহাকাশযানের আকার ও খরচ কমিয়ে এনেছিল। এই মহাকাশবিজ্ঞানী নিজেও এখন ‘স্টারশিপ’ প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

আরেক মহাকাশবিজ্ঞানী এন্ড্রু কোটস এ প্রকল্পকে ‘চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু অসম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন।

“মহাকাশীয় বিকিরণ ও পরিবেশগত বাধা, যন্ত্রের সংবেদনশীলতা, উচ্চ ক্ষমতাসম্প্ন লেজারের সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মিথষ্ক্রিয়া, মহাকাশযানের স্থিতিশীলতা ও শক্তির নিশ্চয়তাসহ নানান বিষয়ের সমাধান এখনও বাকি আছে।

“তবে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে কোনো মানুষের জীবদ্দশায় এটি অন্য নক্ষত্রে পৌঁছানো,” বলেন মুলার্ড স্পেস সায়েন্স ল্যাবরেটরির এ অধ্যাপক।

অবশ্য হকিং এসব শুনতে আগ্রহী নন। তার মতে, ত্রিশ বছরের মধ্যেই এসব সমস্যা উতরে স্টারশিপ ‘নতুন পৃথিবীর’ সন্ধান দেবে।

বিবিসিকে এই পদার্থবিদ বলেন, “আমাদের সব ডিম একটি ভঙ্গুর ঝুড়ির মধ্যে রাখাটা মুর্খামি হবে।

“গ্রহাণু ও সুপারনোভার মতো মহাজাগতিক ঘটনা পৃথিবীর প্রাণকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এ মুহূর্তে কোনো দূরত্বই নক্ষত্রের চেয়ে কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।”