অর্থকষ্টে থাকলেও কারও কাছ থেকে সহায়তা নিতে চান না ৮০ বছর বয়সী এই শিক্ষক।
কিন্তু সরকারি কিংবা বর্তমান এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের মতো অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা থাকলে তাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। তিনিও ওই সহায়তা নিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
তিনি যখন অবসরে যাচ্ছিলেন তখন বেসরকারি বিদ্যালয়ে অবসরকালে কোনো সুযোগ সুবিধা পাওয়া যেত না, যদিও এখন চালু হয়েছে।
মাগুরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ এস এম মাজিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার সময় ৭৫ মাসের মূল বেতন এবং আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ২৫ মাসের মূল বেতন (মোট ১০০ মাস) এককালীন পান।
“এছাড়া বর্তমান সময়ে বেতন থেকে প্রতিমাসে একটি অংশ কেটে রাখা হয় কল্যাণ তহবিলের জন্য। সেখান থেকেও কিছু টাকা পান।”
এসব সুবিধার কোনোটিই পাননি কৃষ্ণ গোপাল বা তার সমসাময়িক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা।
বাবার পথ ধরে ষাটের দশকে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মাগুরার কৃষ্ণ গোপাল ভট্টাচার্য্য। ৪০ বছর শিক্ষকতা জীবন শেষ করে বর্তমান পার করছেন অবসর জীবন।
বাড়িতে ৯০ শতাংশের মতো জমিতে গাছগাছালি রয়েছে। কিছু অংশে চাষবাস হয়। তাতে তার চলে যায়। দেশে বিদেশে রয়েছেন তার বহু ছাত্র, যারা তাকে সহায়তা করতে চান। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন এই শিক্ষক কারও কাছ থেকে সহায়তা নিতে চান না।
মাগুরা জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে শালিখা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের মনোখালী গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন কৃষ্ণ গোপাল ভট্টাচার্য্য।
মাগুরা-নড়াইল সড়কে মাগুরা জেলার শেষ গ্রাম মনোখালী। প্রধান সড়ক থেকে নেমে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরে দুয়েকটি বাড়ি পেরুলেই গোপাল স্যারের বাড়ি। নানা গাছ-গাছালিতে ঘেরা বাড়িটি এলাকায় ভট্টচার্য্য বাড়ি হিসেবে পরিচিত। বড়ি বলতে ভাঙ্গাচোরা ছোট্ট দুটি খুপড়ি ঘর, যার একটি ঘর কখনও কখনও ব্যবহার হয় রান্নার কাজে। অন্য যে ঘরটি আছে তার টিনের চালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। এই ঘরে টিনের আচ্ছাদনের নীচে খোলা বারান্দায় পাতা দুটি খাট। একটিতে বসবাস করেন গোপাল স্যার ও তার অপরটিতে প্রতিবন্ধী ছোট ভাই খোকন ভট্টাচার্য্য।
তার বাড়ি গেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধির সঙ্গে তিনি নানা বিষয়ে কথা বলেন।
গোপাল ভট্টাচার্য্য বলেন, তার বাবা পরেশ নাথ ভট্টচার্য্য ১৯২৪ সালে গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। ৬৪ সালে তিনি অবসরে যান এবং শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসেন। তার বাবা শিক্ষক হিসেবে ওই সময় এলাকায় সবার শ্রদ্ধেয় ছিলেন।
“সে সময়ে শিক্ষদের মান মর্যাদা থাকলেও ছিল চরম আর্থিক দৈন্য, যে কারণে অবসর গ্রহণের পর খুব অর্থকষ্টের মধ্যে প্রায় আট বছর রোগভোগের পর তার মৃত্যৃ হয়।”
নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর ১৯৬৪ সালে বাবার পথ ধরে তিনিও গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা শুরু করেন। প্রথমে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ালেও পরে তিনি শুধু ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করাতেন। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে তিনি প্রায় ৪০ বছর শিক্ষকতা করে অবসরে যান।
বাবা অবসরে আসার সময় স্কুল থেকে উপহার হিসেবে ছাতা ও লাঠি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অবশ্য এসব নিয়ে তার আক্ষেপ নেই। বরং তিনি কিছু না নেওয়ার জন্য আত্মতৃপ্তি বোধ করেন।
শিক্ষকতার বেতন হিসেবে স্কুল থেকে পাওয়া মাসিক সামান্য টাকায় ছোট ভাই খোকন ভট্টচার্য্য ও বিধবা জ্যাঠাত বৌদি ও তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার। এক সময় বৌদি মারা যান এবং পাত্রস্থ করেন জ্যাঠাত বোনকে। নিজের সংসার পাতা হয়নি গোপাল স্যারের। বৌদির মৃত্যুর পর খুপড়ি ঘরটি খালি হলেও খোলা বারান্দা ছেড়ে গোপাল স্যার আর ঘরে যাননি। খোলা বারান্দাতেই বসবাস করেন একটি খাটে।
তার ছাত্ররা দেশের বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সেনা কর্মকর্তা। শুধু দেশে নয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার ছাত্ররা বড় বড় পদে রয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত তার খোঁজখবর রাখেন। অনেক ছাত্র তাকে সাহায্য সহযোগিতা এমনকি ভালো বাড়িও করে দিতে চান।
কিন্তু এসব তার কাছে জবরদস্তি বলে মনে হয়। তিনি সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছাড়া কারও কাছ থেকে কিছুই নিতে চান না।
স্থানীয় ব্যবসায়ী গঙ্গারামপুরের জাকির হোসেন বলেন, এলাকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষক মাথা উঁচু করে থেকেছেন সারা জীবন। আর্থিক দৈন্য তার কাছে তুচ্ছ বিষয়।
গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এমদাদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গোপাল স্যার হলেন আপাদমস্তক নিবেদিত প্রাণ একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা জীবনে ছাত্ররা তাকে বলতেন ইংরেজির জাহাজ। তিনি অকাতরে শুধু শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গেছেন। বিনিময়ে নেননি কিছুই।
গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক কুমারেশ চন্দ্র দে নিজেও কৃষ্ণ গোপাল ভট্টাচার্যে্যর ছাত্র।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার পাঠদান অত্যন্ত মধুর ও প্রাণবন্ত ছিল। সব ছাত্রের কাছে তিনি খুবই প্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
শালিখা উপজেলা শিক্ষক সমিতি থেকে স্যারকে একবার কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল বলে জানান কুমারেশ।
মাগুরা জেলা শিক্ষক সমিতির (কামরুজ্জামান গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম নীলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষক আর্থিক সহায়তা চাইলে সমিতির পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া হয়।