‘মোর এ্যাহনা ইলিপের বেবস্তা করি দ্যান না’

ছয় দিন ধরে বন্যার পানিতে ভাসছে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন; পানি ঢুকে পড়েছে উপজেলা শহরেও।

আহসান হাবীব নীলু  কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2017, 03:18 PM
Updated : 16 August 2017, 04:01 PM

বন্যার্ত ২৭ হাজার ৩০২টি পরিবারের প্রায় এক লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পড়েছে খাদ্য সঙ্কটে। নেই বিশুদ্ধ পানি ও গো খাদ্যের ব্যবস্থা। তাছাড়া ছড়িয়ে পড়ছে চর্ম রোগসহ পানিবাহিত নানা রোগ।

বন্যাক্রান্ত হওয়ার পর ৬৫ মেট্রিক টন চাল ৬৫০০ পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হলেও বঞ্চিত রয়ে গেছে প্রায় ২০ হাজার ৮০২ পরিবার। ফলে ত্রাণের জন্য সর্বত্র চলছে হাহাকার।

রমনা ইউনিয়নের মুদাফৎখানা গ্রামের পরেশ চন্দ্রের (৮০) বাড়িতে ছয় দিন ধরে বুক সমান পানি। স্ত্রী ও এক নাতিকে নিয়ে উঠেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে। বাই-সাইকেল মেকার এই বৃদ্ধের এখন কোনো আয় নেই। ঘরে কোনো খাবারও নেই।

বুধবার দুপুরে জোড়গাছ নতুন বাজার এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী ত্রাণ কেন্দ্রের সামনে অনুনয়-বিনয় করছেন একটা রিলিফের স্লিপের জন্য।

দীর্ঘ প্রতীক্ষায়ও ত্রাণ না পেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদককে বলেন, “সকাল থাকি না খায়া আছং বাহে, মোর এ্যাহনা ইলিপের বেবস্তা করি দ্যান না ক্যাঁ।”

রিলিফের জন্য একইভাবে ধরনা দিচ্ছেন রমনা খামার গ্রামের  স্ত্রী হাজিরন (৬০) ও তরুণা বালা (৬৫)।

ত্রাণ না পেয়ে তারা অভিযোগ করেন, গরিব মানুষ ‘রিলিফ পায় না’। যাদের আছে তারাই বারবার পায়।

সরেজমিনে দেখায় যায়, রমনা ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে থৈ থৈ পানি। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে জোড়গাছ নতুন বাজারের অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে। কাদা পানিতে দাঁড়িয়ে শত শত নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছে ত্রাণের জন্য। কিন্তু সবার ভাগ্যে জোটেনি ত্রাণের স্লিপ।

ধন্যের পাড়ের নুরভানু বেগম (৬০), সকিনা (৫০), তেলিপাড়ার আব্দুর রহমান (৫০), ভট্টপাড়ার মালেকা বেগম (৪৮), মিস্ত্রিপাড়ার রাহেনা (৪৪), ওয়াপদা বাঁধের মেহেনা (৩৯), নুরনাহার (৪২), মাজেদা (৪৭) ত্রাণ না পাওয়ায় অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছের মানুষ না হওয়াতে তারা ত্রাণ বঞ্চিত হয়েছেন।

রমনা মাস্টার পাড়ার দিনমজুর ছক্কু মিয়ার স্ত্রী ইয়ারন বেগম (৫০) বলেন, তিন সন্তান নিয়ে ছয়দিন ধরে পানিবন্দি থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা মেলেনি।

রমনা ইউনিয়নের অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করছেন ট্যাগ অফিসার কবিরুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি আবু হানিফ ও ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মিনারুল ইসলাম দোলন।

চাল মাপার ঝামেলা এড়াতে প্রতিটি ৩০ কেজি ওজনের বস্তা তিনজনকে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।

ট্যাগ অফিসার কবিরুল ইসলাম বলেন, ত্রাণ বিতরণের বিতর্ক ও অভিযোগ এড়াতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

রমনা ইউপি সচিব মিনারুল ইসলাম দোলন বলেন, সোমবার আট মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া যায়। মঙ্গলবার জাতীয় শোক দিবস থাকায় মাল উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। তাই বুধবার ৮০০ পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়।

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল কাদের অভিযোগ করেন, তার ওয়ার্ডের বন্যা আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা এক হাজার ৪০০। অথচ ত্রাণ পেয়েছেন মাত্র ১৫০ জন।

রমনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজগর আলী বলেন, বন্যায় আট হাজার পরিবার বানভাসি। ৮০০ মানুষকে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হলেও ত্রাণ বঞ্চিতের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার।

গত ছয়দিন ধরেই এই ইউনিয়নের ৯০ ভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত বলে জানান তিনি।

নয়ারহাট ইউপি চেয়ারম্যান আবু হানিফা জানান, তার ইউনিয়নে ৩৫০০ পরিবার পানিবন্দি। এখন পর্যন্ত তিনি ১০ মেট্রিক টন চাল পেয়েছেন। যা বুধবার এক হাজার পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়। ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ার কারণে হতদরিদ্র আড়াই হাজার পরিবারকে সহায়তা করা সম্ভব হয়নি।

চিলমারী ইউপি চেয়ারম্যান গওছল হক মণ্ডল জানান, ঘরে ঘরে শুধু খাদ্য সঙ্কটই নয়, গো খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের রোগ ব্যাধি। কিন্তু চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

রাণীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, তিনি মাত্র ১০ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। এই ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা সাত হাজার। প্রতিদিন শত শত মানুষ ত্রাণের জন্য ভিড় করে বাড়িতে।

অষ্টমীর চর ইউপি চেয়ারম্যান আবু তালেব ফকির বলেন, এখনো বন্যার্ত আড়াই হাজার পরিবারকে ত্রাণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

থানাহাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মিলন বলেন, ত্রাণ চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মির্জা মুরাদ হাসান বেগ বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২৭ হাজার ৯১ এবং নদী ভাঙনের শিকার ২১১ পরিবার।

বুধবার ৬৫০০ পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয় বলে জানান তিনি।