তুফানের কুখ্যাতি মুখে মুখে, এলাকাবাসী এখনও সন্ত্রস্ত

কিশোরীকে ‘ধর্ষণ’ ও মা-মেয়েকে ন্যাড়া করার পর আলোচনায় আসা বগুড়ার তুফান সরকারের নানা অপরাধের আলোচনা এখন মানুষের মুখে মুখে।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2017, 12:42 PM
Updated : 3 August 2017, 11:23 AM

রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় খুন-ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধ করে কোটিপতি বনে যাওয়ার খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

অনেকেই কথা বললেও কেউ নাম প্রকাশে রাজি নন। তুফান গ্রেপ্তার হলেও তার সম্পর্কে ভীতি এখনও যায়নি তাদের মন থেকে।

বগুড়ার চকসূত্রাপুর কসাইপট্টির মজিবুর রহমান সরকারের ছোট ছেলে তুফান। মজিবুর মাংস ও চামড়া বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। তার মেজ ছেলে আবদুল মতিন সরকার বিভিন্ন চাঁদাবাজি, হত্যা ও মাদক মালার আসামি। কয়েক বছর আগে তিনি জেলা ট্রাকমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়ে প্রভাব বিস্তার করেন।

এই মতিন ও শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন শেখ হেলালসহ কয়েকজনের হাত ধরে তুফান নাম লেখান রাজনীতিতে। কয়েক বছর আগে তিনি হন বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক।

২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর চকসূত্রাপুর এলাকার যুবদলকর্মী এমরান খুনের পর তুফানের কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। দিনের বেলা খুন হওয়া এমরানের খণ্ডবিখণ্ড লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তুফান ওই মামলার আসামি।

তুফানের স্ত্রীর বড়বোন মারজিয়া হাসান রুমকি ও শাশুড়ি রুমি খাতুন

এই হত্যাকাণ্ডের পর তুফান দখল, চাঁদাবাজি, জুয়া ও মাদক ব্যবসায় জড়ান বলে এলাকাবাসী ভাষ্য। তারপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অর্থের সঙ্গে পেয়েছেন রাজনৈতিক মর্যাদাও।

বগুড়ার জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, তুফানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও মারধরসহ ছয়টি মামলা রয়েছে।

এলাকাবাসী বলছে, প্রাণের ভয়ে অনেক ঘটনায় তুফানের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে সাহস পায় না। সব ঘটনায় মামলা হলে কয়েকশ হয়ে যেত।

শতাধিক মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে চলতে দেখা যেত তুফানকে। লোকেরা তার বহরকে বলে ‘তুফান মেইল’।একসঙ্গে এত মোটরসাইকেল দেখলেই লোকজন আশঙ্কা করত হয়ত তুফানের তাণ্ডবে কোথাও ভাংচুর বা বেদখল হবে।

বাদুড়তলার অনেকের মতো এক মুদি দোকানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তুফান কোনো সন্ত্রাসী অপারেশনে গেলে বলে- ‘সিনেমার তুফান বছরে একবার আসে। যখন আসে তখন সবাই ভাসে। আর আমি তুফান বারবার আসব। যখন আসব তখন খবর করে দিব’।

এক সময়কার তুফানের সঙ্গী নামাজগড়ের এক যুবক বলেছেন, টেকনাফের এক প্রভাবশালীর সঙ্গে তুফানের যোগাযোগ রয়েছে। সেখান থেকে আসে ইয়াবা। এছাড়া মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তুফান নতুন নতুন অস্ত্র সংগ্রহ করেন টেকনাফ ও ভারতের বালুর ঘাট থেকে।

তুফান চকসুত্রাপুর সুইপারপট্টির পাশে হাউজিসহ নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের জুয়ার আড্ডা বসাতেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক শ্রমিকনেতা।

তিনি বলেন, জুয়ার আড্ডায় পাহারাদার থাকত তুফানের একদল অস্ত্রধারী তরুণ-যুবক। জুয়ার সঙ্গে সেখানে চলত মাদক কেনাবেচা।

জুয়ার মেলায় তুফানের বাহিনীর জন্য প্রতি রাতেই পোলাও খাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। রমজানে জুয়া চলার সময় সেহরির ব্যবস্থাও করা হতো বলে এই শ্রমিকনেতা জানান।

বাদুরতলা এলাকার এক প্রেস ব্যবসায়ী বলেন, কোটিপতি তুফান এখন দুটি প্রাইভেট কার নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। এর একটি তার স্ত্রী আশার নামে। তুফান বাহিনীকে কিনে দেওয়া হয়েছে ৫০টি মোটর সাইকেল। এছাড়া প্রতিদিন ক্যাডারদের ভাতাও দেওয়া হতো। এভাবে ক্যাডারতে দিনরাত তার সঙ্গে রাখতেন।

চকসুত্রাপুর এলাকার মানুষ জানান, তুফানের চকসুত্রাপুরে নির্মাণাধীন চার তলা বাড়ির কয়েকটি প্রবেশ পথে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাহারায় থাকে প্রায় অর্ধশত তরুণ-যুবক। বাড়ির সামনে সব সময় পাহারায় থাকে অস্ত্রধারী ক্যাডার ২০-৩০টি মোটরসাইকেলসহ।

তুফানের ডাক আসলেই সঙ্গে সঙ্গে এদিক ওদিক থেকে শতাধিক মোটরসাইকেলে তারা এসে হাজির হতো। তারপর একসঙ্গে জোরে হরন বাজাতে বাজাতে গন্তব্যে ছুটে চলে।

ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশা চালক বলেন, তুফানকে এক হাজার টাকা দিয়ে পাশ নিয়েছিলেন তিনি। তুফানের পাশ ছাড়া শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলতে দিত না। এক হাজার টাকা ছাড়াও শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে তার বাহিনী দিয়ে প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ২০ টাকা করে তোলা হতো।

শহরে এবং শহরতলীতে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে প্রায় তিনবছর তুফানের বাহিনী চাঁদা তুলেছে বলে জানান এই অটোরিকশা চালক।

চকসুত্রাপুর এলাকার কয়েকজন জানান, তুফানের দামি দুটি প্রাইভেট কার রয়েছে। চারতলা ভিত দিয়ে বাড়ি নির্মাণ শুরু হয়েছে, যার দোতলা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। চকযাদু সড়কে তার নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চকসুত্রাপুর এলাকায় আরও কয়েকটি জায়গার মালিক তিনি।

বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তুফানদের কার্যকলাপের বিষয়ে কথা বলতে ভয় লাগে। আমার মতো দলের অনেকেই তুফান সরকার ও তার ঘনিষ্ঠজনদের দেখে ভয় পায়। আমি অনেক আগেই তুফান সরকারকে বহিষ্কারের কথা সাধারণ সম্পাদক শামছুদ্দিন শেখ হেলালকে বলেছিলাম। তিনি তুফানকে দলে নিয়েছিলেন।”

বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলার কার্যক্রম দ্রুত গতিতে চলছে। এর বাইরে তুফান সরকারের আর কী কী অপরাধ রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী জানান, তুফানকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও তার কর্মকাণ্ডের তথ্য নিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক কিশোরীকে ভালো কলেজে ভর্তির প্রলোভন দেখিয়ে ১৭ জুলাই ও পরে কয়েকবার ধর্ষণ করেন শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন তার কয়েকজন সহযোগী।

বিষয়টি জানতে পেরে তুফানের স্ত্রী আশা ও তার বড় বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকিসহ ‘একদল সন্ত্রাসী’ শুক্রবার দুপুরে ওই কিশোরী এবং তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের মারধর করে নাপিত দিয়ে মা ও মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেন।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তার তুফান, তার স্ত্রী আশা, কাউন্সিলর রুমকি, শ্বশুর-শাশুড়ি, গাড়িচালক, নরসুন্দর ও মুন্না নামের এক যুবককে করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।