বিশুদ্ধ পানির সংকটে গাইবান্ধার বানভাসী মানুষ

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গাইবান্ধার বন্যা কবলিত চার উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের দুই লাখেরও বেশি বানভাসী মানুষ খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছে।

গাইবান্ধার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2017, 02:54 PM
Updated : 12 July 2017, 03:05 PM

বুধবার  ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে করতোয়া ও তিস্তার পানি।

তাছাড়া বন্যা কবলিত গাইবান্ধা সদর সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি।

চার উপজেলায় ৮২টি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরমধ্যে ১৭টিতে বন্যা কবলিত মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।

বানের দুর্ভোগের সঙ্গে তীব্র হয়েছে নদী ভাঙন। গত চারদিনে সদরের কামারজানি, ফুলছড়ির ফজলুপুর ও উড়িয়া ইউনিয়নে দেড় শতাধিক পরিবার ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে।

এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব রতনপুর গ্রামের লাকী বেগম বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। ছেলে-মেয়েদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোমর পানিতেই আছেন স্বামী-স্ত্রী।

“শুকনো খাবার বলতে ঘরে তেমন কিছু নেই। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বেশি কষ্টে আছেন তারা। কিন্তু বিশুদ্ধ পানির অন্য কোনো উৎস না থাকায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের পানি দিয়ে চলছে নিত্যদিনের কাজকর্ম।”

একই গ্রামের মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, “বাবা খাওয়া দাওয়া যাই হোক পানিতো খাওয়া নাগবে। এই বানের পানিত মরা গরু ভাসি বেড়ায়। ঘেন্না নাগে। তাও ডোবা কলের পানি খাবার নাগচি।

তাছাড়া টয়লেটগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। একই পরিস্থিতি গোটা পূর্ব রতনপুরের।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কলিম উদ্দিন বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, টিউবওয়েল উঁচু করার জন্য লোহার পাইপ, ১৪টি হাইজিন সামগ্রীর একটি প্যাকেট ও ব্লিচিং পাউডার বিতরণ এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নলকুপ ও অস্থায়ী ল্যাট্রিন শেড স্থাপনের জন্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশক্রমে সেগুলো বিতরণ ও স্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।

উড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহাতাব উদ্দিন বলেন, তার ইউনিয়নের দেড় হাজার বানভাসী মানুষের বিপরীতে ২০০ মানুষের জন্য ১০ কেজি করে মাত্র ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়। উপজেলার বিপুল সংখ্যক বানভাসী মানুষের জন্য এই ত্রাণ একেবারেই অপ্রতুল।

সাঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সুইট বলেন, তার ইউনিয়নে সাত হাজার মানুষ পানিবন্দি হলেও মাত্র দেড়শ মানুষের জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, বুধবার দুপুর পর্যন্ত ২২৫ মেট্রিকটন চাল ও ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৯০ মেট্রিকটন চাল ও ৬ লাখ টাকা বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি অংশে কাতলামারী, সিংড়িয়া ও রতনপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাঁধের নিরাপত্তায় বেশ কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশ ও এলাকাবাসী দিনরাত টহল দিচ্ছে।

এলাকাবাসীর আশঙ্কা বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে ফুলছড়ি উপজেলা হেডকোয়ার্টারসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “কামারজানির ভাঙন বেশ কিছুদিন ধরেই আছে এবং আমরা ওখানে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।”

এছাড়া সব এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে তদারকি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বন্ধ ১৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২৩টি ও ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম মণ্ডল জানান, এরমধ্যে সুন্দরগঞ্জে ১৫টি, গাইবান্ধা সদরে ১৯টি, ফুলছড়িতে ৫৯টি ও সাঘাটা উপজেলায় ৩০টি।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, গাইবান্ধা সদরে একটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসা, ফুলছড়িতে ৪টি স্কুল ও ২টি মাদ্রাসা ও সাঘাটায় ১টি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ কর্মস্থলের বাইরে না যেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা ব্যবস্থাপনায় তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে।

বানভাসী মানুষের জন্য সরকারের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে। চাল-ডালের পাশাপাশি শুকনো খাবারও বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণের সঙ্গে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের আশ্বাস দেন তিনি।

পাশাপাশি বানভাসীদের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।