দোহার ও নবাবগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক ভোগান্তি

ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের বহু গ্রাহক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ‘কৌশলে অতিরিক্ত বিল’ আদায়সহ নানা অভিযোগ এনেছেন।

আসাদুজ্জামান সুমন দোহার-নবাবগঞ্জ-কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2017, 02:19 PM
Updated : 29 June 2017, 07:37 AM

এক মাসের বিল আরেকমাসে দেওয়া, মিটারের রিডিংয়ে গড়মিল, বিলে ইউনিট বাড়িয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে গ্রহকদের।

কোনো কোনো গ্রাহক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি অফিসে গিয়ে বিলের কাগজ ঠিক করে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ যেমন আছে তেমনই বিল দিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

চুক্তিভিত্তিক কাজে নিয়োজিত দুই মিটার রিডারকে ধরে পিটুনিও দিয়েছেন গ্রাহকরা।

সরেজমিনে ঢাকার নবাবগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী দোহার উপজেলায় ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর কার্যালয় ও গ্রহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

বড় বক্সনগর এলাকার ষাটোর্ধ্বে বয়সী শ্রী পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধির।

তিনি বলেন, “আমাগো বিলও বেশি আইছে। শুধু আমাগো নয় এলাকার সবার বাড়িতেই এ মাসে বিল বেশি আইছে।

“তাই অনেকেই এখানে আইসা লাইনে দাঁড়ায়ে বিল ইচ্ছেমতো বানায়ে নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ গত মাসের বিলের সাথে মিল রেখে বিল সংশোধন করে জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে।”

বিদ্যুৎ অফিসে চেঁচামেচি করছিলেন পানালিয়া এলাকার বাসিন্দা নওয়াব।

তাকে চেঁচামেচি করার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, “গত মাসের চেয়ে এ মাসে আমার দুই গুণ বেশি বিল আসছে। চেঁচামেচি করব না তো কী করব?  ভুল দুয়েকজনেরটায় হতে পারে, সবারটায় কীভাবে ভুল হয়? পল্লী বিদ্যুৎ কিসের স্বার্থে এ ধরনের কাজ করল ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে এর মধ্যে কিছু একটা তো আছেই।”

বাগমারা এলাকার বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন বলেন, গত ২ জুন মিটারের রিডিং লিখে নিয়ে যান পল্লী বিদ্যুতের লোকজন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ মাসের ১৭ তারিখে বাড়িতে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ আসে।

“তাতে দেখি গত মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিল এসেছে। আবার ২১ জুন বিল পরিশোধের শেষ তারিখ দেওয়া হয়েছে। তাই ২১ জুন বুধবার সকালে বিল পরিশোধ করতে যাওয়ার আগে মিটারের সাথে বিলের কাগজের রিডিং মিলিয়ে দেখি মিটারে মোট রিডিং ১৩২১৫ ইউনিট। অথচ বিলের কাগজে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ২ই জুন পর্যন্ত মিটারে মোট রিডিং ছিল ১৩৩০০ ইউনিট।”

তিনি বলেন, “পল্লী বিদ্যুতের লোকজন আরও বিশ দিন আগে যখন ইউনিট লিখে নিয়ে গেছেন তখন ইউনিট আরও কম ছিল। ২০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের দেওয়া রিডিং থেকে ৮৫ ইউনিট কম আছে আমার বাড়ির মিটারে।

“তাহলে কী এভাবেই ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ গ্রাহকদের কাছ থেকে কৌশলে অতিরিক্ত বিল আদায় করে লাভবান হচ্ছে?”

একই এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী কমল সাহা বলেন, শুধু বাগমারা এলাকার বাসিন্দাদের বিল বেশি আসেনি। আশপাশের সব এলাকাতে একই অবস্থা। এমনকি দোহার উপজেলার অবস্থাও এক। আমার বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মিটারে যে রিডিং রয়েছে বিলের কাগজে তার চেয়ে অনেক বেশি ইউনিট যুক্ত করে এ মাসের বিল করা হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় প্রায় ডাবল।

“মিটার দেখে সমস্যা ধরতে পেরে ভুক্তভোগী আরও কয়েকজন মিলে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে গেলে সেখান থেকে আমাদের বলা হয় সামনের মাসে বিল অনেক কম আসবে। এ মাসে যা বিল আসছে দিয়ে যান। তাই বিল দিয়ে চলে আসছি।”

সুমাইয়া আক্তার নামে এক গৃহবধূ বলেন, ইউনিট অনুসারে বিদ্যুৎ বিল তৈরি করে পল্লী বিদ্যুৎ। আবাসিকে ০ (শূন্য) থেকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত প্রতি ইউনিট দর ৩.৭৫ টাকা। ৭৬-২০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রতি ইউনিট দর ৫.১৪ টাকা। ২০১-৩০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রতি ইউনিট দর ৫.৩৬ টাকা। এভাবে ইউনিট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দরও বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং মোট ব্যবহৃত ইউনিট যত কম হবে ইউনিট প্রতি দর তত কম হবে। তাতে মোট বিলও কম আসবে।

“ফলে এ মাসে পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বিলে ইউনিটের পরিমাণ বেশি লিখে কৌশলে জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে লাভবান হতে চেয়েছিল; কিন্তু ধরা পড়ে গেছে।”

এলাকাবাসী জানান, গত শনিবার (১৭ জুন) ইকরাশী ও কাচারীঘাট এলাকায় গ্রাহকদের বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ বিল বিতরণ করতে যান পল্লী বিদ্যুতের মাঠকর্মী মো. জানে আলম ও মো. হাবিব।

বিগত মাসের তুলনায় চলতি মাসের বিদ্যৎ বিলের বড় অঙ্কের অসামঞ্জ্য দেখে সন্দেহ হলে গ্রাহকরা যে যার মিটারে থাকা রিডিং দেখে বুঝতে পারে প্রতিটি বিলের কাগজেই ইউনিট বাড়িয়ে বেশি বিল করা হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুতের এমন কাণ্ডে গ্রাহকরা তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিষয়টি জানাজানি হলে বিলের কপি নিয়ে এলাকাবাসী রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে বাড়িতে বাড়িতে বিল বিতরণ করতে থাকা পল্লী বিদ্যুতের মাঠকর্মী জানে আলম ও হাবিবকে অবরুদ্ধ করে লাঞ্ছিত পিটুনি দেন।

পরে এলাকাবাসী জানতে পারেন হাবিব পল্লী বিদ্যুতের কোনো কর্মচারী নন। তিনি চুক্তিতে কাজ করে দেন।

হাবিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি পল্লী বিদ্যুতে কর্মরত কেউ নই। আাগে দোহারে কাজ করতাম। আমার চাকরি শেষ হয়েছে ছয় মাস আগে। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন জানে আলম ভাই। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।”

জানে আলম বলেন, “এই দুই গ্রামে চার হাজার গ্রাহকের বিল বিতরণের দায়িত্ব ছিল আমার। এত বিল একার পক্ষে বিলি করা সম্ভব নয় বলে আমি হাবিবকে নিয়ে এসেছিলাম। আর বাড়তি বিলের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারব না। এটা অফিসের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।”

হাবিব ও জানে আলমকে পিটুনির খবর পেয়ে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর দোহার জোনাল অফিসের এজিএম এস এম রাশেদুজ্জামানসহ আরও দুই কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে অতিরিক্ত বিলের বিষয়ে ভুল স্বীকার করে তা সমাধানের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

বিলে অতিরিক্ত ইউনিট যোগ করে বিল করার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘অধিকাংশ গ্রাহকের নয় কিছু সংখ্যক’ গ্রাহকদের বিলে ইউনিট বাড়িয়ে বিল প্রস্তুত করা হয়েছে। কেননা প্রতি মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রাহকের বিল প্রস্তুত করা হয়।

ক্লোজিং মাস ও ২৩ জুন থেকে কয়েকদিন ঈদের ছুটি থাকার কারণে তো এ কয়েকদিনের ইউনিট গ্রাহকদের বিলের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। তাই যিনি বিলটা করেছেন তিনি অনুমান করে আগে থেকেই ইউনিট বাড়িয়ে বিল প্রস্তুত করেছেন। যদি ক্লোজিং মাস ও ঈদের কয়েকদিন ছুটি না থাকত তাহলে এমনটা কখনও হতো না বা এর আগে কখনও তো এমনটা হয়নি।

এছাড়াও যেসকল গ্রাহক এ সমস্যা নিয়ে অফিসে আসছেন তাদের বিল সংশোধন করে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান জিএম।

প্রতি মাসের বিলের সঙ্গে সার্ভিস চার্জ, ডিমান্ড চার্জ, পাওয়ার ফ্যাক্টর চার্জ, মিটার ভাড়া ইত্যাদি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেওয়া হচ্ছে বলে জানান প্রকৌশলী আলমগীর।

ইউনিট বাড়িয়ে গ্রাহকদের যে বিদ্যুৎ বিল করা হয়েছে এটা কোন মাসের বিল জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, জুন মাসের বিল।

গ্রাহকদের বিলের কাগজে মিটার রিডিংয়ের বর্তমান তারিখ ০২ জুন ২০১৭  ও পূর্ববর্তী তারিখ ১১ মে ২০১৭।

এ ব্যাপারে প্রকৌশলী আলমগীর বলেন, গ্রাহকদের বিলে ১১ জন ২০১৭ হওয়ার কথা ছিল থাকলেও তারিখ লেখা রয়েছে ০২ জুন ২০১৭। এর কারণ হলো হিসাবটা এক মাসের মধ্যে রাখার জন্য এটা করা হয়েছে। আবার পরের মাসে যখন বিলটা হবে তখন সেখানে ১১ জুলাই ২০১৭ হবে।

“বুধবার রাতে আপনি মোবাইল ফোনে বলেছিলেন কিছু সংখ্যক গ্রাহকের বিলে সাতদিনের ইউনিট বাড়িয়ে বিল করা হয়েছে; সেক্ষেত্রে তাদের বিল তো ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো গ্রাহকের বিল দ্বিগুণও হয়েছে। এটা কীভাবে হলো?।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, “এরকম হওয়ার কথা না। মূলত ঈদের আগে জুনের ২৩ তারিখ থেকে ছুটির কারণেই ইউনিট বাড়িয়ে বিল করা হয়েছে। যে কয়দিন ঈদের ছুটি থাকবে সে কয়দিনের রিডিং আমাদের লোকজন তো নিতে পারবে না এবং বিলও পৌঁছাতে পারবে না।”

“তাই যে কয়দিন ঈদের ছুটি থাকবে আনুপাতিক হারে সে কয়দিনের বিল বেড়ে যাওয়ার কথা। তারপরও যদি কারও বিলে বড় অঙ্কের অসামঞ্জ্য থাকে তাহলে সে অফিসে আসলে সেটি ঠিক করে দেওয়া হবে।”

ঈদের ছুটির কারণে বিলে ইউনিট বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জিএম বলেন, “আমরা যদি সাতদিনের ইউনিট বাড়িয়ে বিলটা না করতাম তাহলে এ মাসের সাতদিনের রিডিং আগামী মাসে যোগ হয়ে বিল আসত। এতে বিল অনেক বেশি হতো। সেক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ত।”