রাজশাহী সিটির বর্জ্যে নদী দূষণ

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কারখানার তরল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বারনই নদী। প্রতিদিন এই নদীতে পড়ছে হাজার হাজার লিটার রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত তরল বর্জ্য।

বদরুল হাসান লিটন রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2017, 04:04 PM
Updated : 7 June 2017, 04:04 PM

এর প্রভাব পড়ছে বারনই নদী প্রবাহের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। এতে মারা যাচ্ছে মাছ। এসব বর্জ্যের তলানি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। জীবিকার সঙ্কটের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে নদীপাড়ের হাজার হাজার মানুষ।

একই কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বারনই নদীতে পানি সংরক্ষণ প্রকল্প। গত বছর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের জগদিশপুরে বারনই নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয় পানি সংরক্ষণের জন্য।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র থাকা অবস্থায় দুইটি তরল বর্জ্য শোধানাগার নির্মাণের প্রস্তাবনা তৈরি করেন। কিন্তু গত নির্বাচনে তিনি পরাজিত হওয়ার পর এ প্রস্তাবনা আর আলোর মুখ দেখেনি।

তবে বিষয়টি সরকারের নজরে আনতে সংসদে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন।

ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মৌখিকভাবে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এলাকাবাসী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ড্রেনের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বারাহী ও নবগঙ্গা খালে। এতে ওই দুইটি খালের পানি সম্পূর্ণ দূষিত হয়ে গেছে।

নবগঙ্গার পানি দুয়ারি হয়ে এবং বারাহীর পানি নওহাটা দিয়ে বারনই নদীতে পড়ছে। এই দুইটি খালের বারনই নদীর সংযোগ স্থলে স্লুইসগেট বসানো হলেও তা খোলা থাকে। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার দূষিত তরল বর্জ্য বারনই নদীতে পড়ছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার দুয়ারী গ্রামের প্রফুল্ল হালদার (৬৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক সময় বারাহী ও নবগঙ্গা খাল এবং বারনই নদীতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। তাদের জীবিকা নির্বাহে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন খালের দূষিত পানিতে মাছ পাওয়া যায় না।

এখন শুধু বারনই নদীদে সামান্য মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এ নদীর পানিও দূষিত হয়ে মাছ মারা যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

নওহাটা পৌরসভার বারনই নদীর পাড়ের মধুসূদনপুর গ্রামের মফিজ উদ্দিন (৫৫) বলেন, বারনই নদী ছাড়া তাদের গোসল করার বিকল্প জায়গা নাই। আগে নদীর পানি ভালো ছিল। এখন তরল বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে গেছে। নদীতে গোসল করলে গায়ে চুলকানি হয়।

“ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বারাহী ও নবগঙ্গা খাল এবং বারনই নদীর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ।”

পবা উপজেলার সেনিটারি ইন্সপেক্টর জালাল আহম্মেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শহরের তরল বর্জ্যে পানি সম্পূর্ণ দূষিত হয়ে গেছে পবার বারানী ও নবগঙ্গা খাল। ওই দুইটি খালের দূষিত পানি বারনই নদীতে পড়ে মাছ মরে যাচ্ছে। এই পানির কারণে খাল ও নদীপাড়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া-চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্ম রোগে।

হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিটি করপোরেশনের তরল বর্জ্য পবার যে দুটি খালে ফেলা হচ্ছে তা এক সময় নদী ছিল। এ দুইটি নদীর নাম বারাহী ও নবগঙ্গা, যা বর্তমানে খালে পরিণত হয়েছে। এই দুইটি খাল বারনই নদীতে সংযুক্ত হয়েছে।

“পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার উচিত নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলা। তাছাড়া দখলমুক্ত করে এই নদী দুটিকে আগের অবস্থায় আনা দরকার।”

পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, গত বছর শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের জগদিশপুরে বারনই নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়। নদীতে মাছের অভয়ারণ্য ও সেচ কাজে ব্যবহারে খরা মৌসুমে পানি ধরে রাখতে এ রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই রাবার ড্যাম নির্মাণের ফলে খরা মৌসুমে বারনই ও ফকিরনি নদীর প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত উজানে পানি থাকে। এই পানি ব্যবহার করে নদীর পাড়ের মানুষ চাষাবাদসহ সকল কাজে লাগিয়ে যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি জেলেরাও মাছ ধরার সুযোগ পাচ্ছে।

“কিন্তু কারখানার তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ার কারণে এ পানি দূষিত হচ্ছে, যা ছাড়িয়ে পড়ছে বারনই নদীর প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার ভাটিতে। মাছ মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে নদীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী অফিসের উপ-পরিচালক নূর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রারাহী ও নবগঙ্গা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে শহরের বিষাক্ত পানি যেন না যায় তার ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

“কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি, চিঠির জবাবও দেয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম হোসেন বলেন, ইতিমধ্যেই নবগঙ্গা নদীসহ দুইটি খালের পানি সম্পূর্নরূপে দূষিত হয়ে গেছে। এখন হুমকির মুখে পড়েছে বারনই নদী।

খাল দুটিতে নালার সংযোগ বন্ধ করাসহ তরল বর্জ্য শোধানাগার নির্মাণের জন্য পবা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনকে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানান তিনি।

রাজশাহী ওয়াসার সচিব সাদেকুল ইসলাম বলেন, নগরীর তরল বর্জ্য শোধনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। তবে তারা নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের জন্য প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। এটি হলে তরল বর্জ্যরে সমস্যা অনেকটাই কমবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা করা আছে। আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে এটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটি হলে আর সমস্যা থাকবে না।