‘ছেলে যদি বদলে যায়, মা কি বদলাতে পারে?’

“আগে মা দিবস এলে আমাকে ফুল এনে দিত, গিফট দিত। ছেলে এখন বদলে গেছে। আমি কোথায় সে জানে, কিন্তু এখন আর খোঁজ নেয় না। সন্তান বদলে গেলেও মায়েরা তো বদলে যেতে পারে না।”

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2017, 05:12 AM
Updated : 14 May 2017, 05:15 AM

বলছিলেন ৬২ বছর বয়সী ফিরোজা রহমান। তার ঠিকানা এখন গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র।

ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পর নানা কারণে আর নিজের পরিবারে থাকতে না পেরে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ফিরোজার মত আরও বহু নারী। রোববার মা দিবসে সন্তানের দেখা না পেলেও তাদের মঙ্গল কামনাতেই এখানে প্রতিটি দিন কাটে তাদের। 

ফিরোজা রহমান ভারতের চেন্নাইয়ের মেয়ে। ১৯৭৭ সালে রাজশাহীর এক প্রকৌশলীর সঙ্গে বিয়ের সূত্রে তার বাংলাদেশে আসা। তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা, স্বামী পিএইচডি করতে চলে যান লন্ডনে। তার কিছুদিন পর তাদের একমাত্র ছেলের জন্ম। কিন্তু স্বামী আর ফেরেননি, কোনো খোঁজও রাখেননি।    

স্বামীর অনুপস্থিতিতে একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করে ছেলেকে বড় করেন এই মা। আশা ছিল ছেলেও বাবার মত প্রকৌশলী হবে। কিন্তু তিনি এখন ঢাকায় কোচিং ব্যবসা করেন। পারিবারিক নানা বিষয়ে মা-ছেলের জটিলতা বাড়তে খাকায় নয় মাস আগে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেন ফিরোজা।

এরপর একটিবারও ছেলে তার খোঁজ নেয়নি বলে জানান জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছানো এই নারী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সন্তানরা খারাপ হলেও মায়েরা কখনও তাদের ক্ষতি চায় না, তাদের এ সম্পর্ক শেকড়ের। দেশে আইনের ব্যাবস্থা আছে, কিন্তু আইন-আদালত করে কী সম্পর্ক ঠিক রাখা যায়?”

তিন বছর আগে যশোর থেকে এক প্রতিবেশীর সহায়তায় গাজীপুরের এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসেন রাবেয়া খাতুন (৭০)। তার স্বামী ছিলেন যশোর জজ আদালতের কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

এরপর বহু কষ্টে কিছু জমি বিক্রি করে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে বড় করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন রাবেয়া। কিন্তু ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার পর সেই লড়াইয়ে হার মানতে হয় তাকে। 

ছেলে-বউদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকায় সংসারের অশান্তি এড়াতে এক পর্যায়ে অভিমানে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন রাবেয়া। মেয়েরা মাঝেমধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেদের কেউ তার খোঁজ নেয় না।

“ছেলেরা কষ্টে পড়ুক, তা আমি চাই না। আমি কষ্টে থাকলেও তাদের কষ্ট দিতে চাই না। যতদিন বেঁচে আছি এখানেই থেকে যেতে চাই।”

গাজীপুর সদর উপজেলার এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ২১০ জন বাসিন্দার মধ্যে ১০৯ জনই নারী। সন্তানদের কাছ থেকে দূরে অতীত দিনের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো বাবা-মা তারা।

গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহ রোডের হোতাপাড়া গিয়ে পশ্চিমে মণিপুর বাজারের দিকে তিন কিলোমিটার গেলেই ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের বিশিয়া কুড়িবাড়ী এলাকায় এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র।

প্রায় ৭২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বেসরকারি এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে কেবল ষাটোর্ধ্বদের বিনা খরচে থাকার সুযোগ আছে। চিকিৎসাসহ দেখভালের দায়িত্বও কর্তৃপক্ষের।

কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আবু শরীফ জানান, ১৯৮৭ সালে উত্তরা আজমপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে চালু হয়েছিল এ আশ্রয় কেন্দ্র। পরে স্থান সংকুলানের জন্য ১৯৯৪ সালে গাজীপুরে নিজস্ব জমিতে স্থানান্তর করা হয়।

পুনর্বাসন কেন্দ্রের জমিতে ফলমুল, শাকসবজি আর পুকুরে মাছ উৎপাদন হয়। সেসব ব্যবহার করা হয় কেন্দ্রের প্রবীণদের জন্য। পাঁচ তলা তিনটি ভবনে তাদের থাকার ব্যবস্থা।

শরীফ জানান, এই কেন্দ্রে সাড়ে সাত বিঘা জমির ওপর রয়েছে কবরস্থান। কেউ মারা গেলে সেখানেই তাদের দাফনের ব্যবস্থা হয়। খ্রিস্টান আর হিন্দু যারা আছেন, তাদের সৎকার করা হয় যার যার ধর্মের নিয়ম মেনে।

এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা গিভেন্সি গ্রুপের চেয়ারম্যান খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল জানান, শৈশবে স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন তিনি দেখেন, এক বৃদ্ধকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে তার ছেলে আর ছেলের বউ। সেই ঘটনাই তাকে এ আশ্রয় কেন্দ্র গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভাব-অনটন আর জীবনের বড় কোনো হতাশা থেকে মমতাময়ী মায়ের সঙ্গেও সন্তানরা খারাপ আচরণ করছে। সন্তানদের এমন আচরণে মা-বাবারা কষ্ট পান, কিন্তু সন্তানের ক্ষতি তারা চান না। তাই সবার অগোচরেই হয়ত তারা সংসার ছেড়ে দূরে চলে যান।”