চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘ঈগল হান্টে’ নিহত ৪

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ‘জঙ্গি আস্তানায়’ দুদিনের অভিযান শেষে চারজনের লাশ মিলেছে, যারা নিজেদের ঘটানো বিস্ফোরণে নিহত হন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2017, 03:16 AM
Updated : 27 April 2017, 04:41 PM

নিহতদের মধ্যে ‘জেএমবির সদস্য’ রফিকুল ইসলাম আবু রয়েছেন বলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি খুরশেদ হোসেন জানিয়েছেন।

আবুর এই ভাড়া বাড়িটি বুধবার সকালে ঘিরে ফেলার পর পুলিশ বলেছিল, ভেতরে তিনি স্ত্রী সুমাইয়া ও দুই সন্তান নিয়ে রয়েছেন।

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অভিযান শেষের ঘণ্টা খানেক আগে আবুর স্ত্রী ও এক মেয়েকে পুলিশ জীবিত অবস্থায় ধরে আনে।

নিহত অন্য তিন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পরিচয় পুলিশ কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। আবুর অন্য সন্তানটি আগে থেকেই তার নানা বাড়িতে ছিল বলে অভিযান শেষে পুলিশ জানায়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তা সহকারী উপকমিশনার আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “একতলা ওই বাড়ির ভেতরে নারী ও শিশুসহ চারজন আছে বলে আমরা ধারণা করছি।”

সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযানের মধ্যে ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ নাম দেওয়া এই অভিযানে দুজনকে জীবিত পাওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন ডিআইজি খুরশেদ।

অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অন্য অপারেশনের চেয়ে এটা আমরা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। এ অভিযানে আমরা আবুর স্ত্রী ও মেয়েকে জীবিত বের করে আনতে সমর্থ হয়েছি।”

এই দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ডিআইজি বলেন, “ভেতরে থাকা নারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে তাদের বার বার বের হয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। সর্বশেষ বিকালেও মাইকিং করে তাদের বের হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।”

শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহিনী গ্রামে আমবাগান ঘেরা আধাপাকা ওই বাড়ি থেকে বিকাল ৫টার দিকে আবুর স্ত্রী ও ৫টা ২৩মিনিটে মেয়েকে বের করে আনা হয়। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা আসে।

জেলা পুলিশের সহযোগিতায় সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের চালানো এই অভিযান শেষে ভেতরে চারজনের লাশ পাওয়ার কথা জানানো হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, এখন ভেতরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ করবে।

ডিআইজি খুরশেদ বলেন, আবুসহ নিহতরা নিজেদের ঘটানো বিস্ফোরণেই নিহত হন।

বুধবার সকালে বাড়িটি ঘিরে ফেলার পর ভেতর থেকে গুলি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তা উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার।

এরপর কয়েক দফা ভেতরে ঢুকতে গিয়ে গ্রেনেড হামলার সম্মুখীন হওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। বুধবার সন্ধ্যায় চূড়ান্ত অভিযান শুরুর পরও চার-পাঁচটি বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া গিয়েছিল।

এরপর রাত ৯টার অভিযান স্থগিতের পর সকালে পুনরায় অভিযান শুরুর পর থেকে ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের আত্মসমর্পণ করতে মাইকে আহ্বান জানানো হয়।

অভিযান শুরুর পর এক-আধ ঘণ্টা পরপর শোনা যায় মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। ১০টা ৬ মিনিটে একবার বিকট বিস্ফোরণ ঘটে।

দুপুর ১২টায় শেষবারের মতো আত্মসমর্পণ করতে বলার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটি বোমা ‘নিষ্ক্রিয়’ করা হয়। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার মুজাহিদুল ইসলাম বলেছিলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখনও বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। তবে বাড়ির ফটকে একটা বোমা পাওয়ার পর সেটা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।”

এরপর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ভেতরে থাকা দুই শিশুকে (একটি শিশু ছিল না, যা পরে জানানো হয়) বের করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এরপর পৌনে এক ঘণ্টা পর আবুর স্ত্রী ও মেয়েকে বের করে হাসপাতাল পাঠানো হয়।

এই অভিযান শুরুর আগেই সকাল ৮টার দিক থেকে ঘটনাস্থলে এনে রাখা হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস। ওই অ্যাম্বুলেন্সে করেই তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিরাপত্তার কথা বলে পুলিশ ওই বাড়ির আশপাশের প্রায় পাঁচ শ গজের ভেতর কাউকে যেতে দেয়নি। আশপাশের চারটি বাড়ির বাসিন্দাদেরও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জেলার এএসপি মাইনুল ইসলাম জানান।

জননিরাপত্তার স্বার্থে শিবগনগর ও আশপাশের এলাকায় বুধবার সকালেই ১৪৪ ধারা জারির কথা বলেন শিবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুল ইসলাম জানান।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালানোর পর পুলিশ গত শুক্র ও শনিবার ঝিনাইদহের একটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চালিয়ে ‘বিপুল বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম’ উদ্ধার করে।

এরপর মঙ্গলবার দিনভর রাজশাহীর একটি এলাকায় কয়েকটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চললেও কোনো জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়নি পুলিশ।

এরপর বুধবার সকালে পুলিশ আবুর বাড়ি ঘিরে ফেলার আগে কানসাট ইউনিয়নের আব্বাস বাজার এলাকার তিনটি বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালায়। তবে সেখানেও কাউকে পাওয়া যায়নি পুলিশ জানায়।

আবু কে?

শহর থেকে দূরে পল্লীর একতলা ওই বাড়িতে মাস তিনেক ধরে রফিকুল আলম আবু (৩০) তার স্ত্রী ও আট ও ছয় বছর বয়সী দুটি মেয়ে নিয়ে সাইদুর রহমান ওরফে জেন্টু বিশ্বাসের ওই বাড়িতে থাকছিলেন।

৭৫ বছর বয়সী জেন্টু বিশ্বাস ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। নিজের পরিবার নিয়ে পাশেই আরেকটি বাড়িতে তিনি থাকেন।

স্থানীয়রা জানান, মাস তিনেক আগে একই উপজেলার চাচরা গ্রামের দিনমজুর আফসার আলীর ছেলে আবু এই বাড়িতে ওঠেন।

একসময় মাদ্রাসায় পড়া আবু একজন ভ্রাম্যমাণ মসলা বিক্রেতা। ত্রিমোহনীর ওই বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে চাচরা গ্রামে তার বাবা-মা থাকেন।

আবুর মা ফুলছানা বেগম বলেন, প্রায় নয় বছর আগে সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ের পর একই উপজেলার আব্বাস বাজারে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন আবু।

ছেলেবেলায় আবু চাচরা গ্রামের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন বলে জানালেও কোন শ্রেণি পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করেছেন- সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি তার মা।

তিনি জানান, আবু দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।