প্রতারণা: রাগীব আলীর ১৪, ছেলে-মেয়ের ১৬ বছরের সাজা

প্রতারণার মাধ্যমে তারাপুর চা-বাগানের ভূমি আত্মসাতের মামলায় সিলেটের ব্যবসায়ী রাগীব আলী ও তার ছেলে, মেয়েসহ পাঁচজনের সাজার রায় দিয়েছে আদালত।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2017, 07:37 AM
Updated : 6 April 2017, 10:13 AM

এর মধ্যে ৮৩ বছর বয়সী রাগীব আলীকে চারটি ধারায় মোট ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আর তার ছেলে আবদুল হাই, মেয়ে রুজিনা কাদির, জামাতা আব্দুল কাদির এবং আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদকে ওই চার ধারায় দেওয়া হয়েছে মোট ১৬ বছর করে কারাদণ্ড।

এ মামলার অপর আসামি তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক।

সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরো বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, চার আসামিকে দুটি ধারায় সাত বছর করে সাজা দেওয়া হলেও বয়স বিবেচনায় রাগীব আলীকে ছয় বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

কার কেমন সাজা

>> রাগীব আলীকে মূল্যবান সম্পদ দখলের জন্য দলিল জালিয়াতির দায়ে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৬৭ ধারায় ছয় বছর, ওই জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণার দায়ে ৪৬৮ ধারায় ছয় বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের জেল দেওয়া হয়েছে।

>> ওই দুটি ধারায় আবদুল হাই, মেয়ে রুজিনা কাদির, জামাতা আব্দুল কাদির এবং আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদকে সাত বছর করে মোট ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

>> এছাড়া জাল দলিল ব্যবহার করে সম্পত্তি হস্তান্তরের দায়ে ৪২০ ও ৪৭১ পাঁচ আসামির সবাইকে এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

>> রায়ে আদালত বলেছে, আসামিদের সব দণ্ড একযোগে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, রাগীব আলীকে মোট ছয় বছর ও বাকিদের সাত বছর করে সাজা খাটতে হবে। 

রায়ের পর সিলেটের পিপি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, “তারাপুর চা বাগানের এই দখলের মামলাটি একটি মহা জালিয়াতির মামলা। আদালতের এ রায় জালিয়াতির বিরুদ্ধে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”

 অন্যদিকে রায়ে অসস্তোষ প্রকাশ করে রাগীব আলীর আইনজীবী আব্দুল মুকিত অপি বলেন, “আদালতে আসামিরা ন্যায়বিচার পায়নি। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।”

আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা রাগীব আলী ও আবদুল হাইকে বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা মোস্তাক ও পঙ্কজও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর রুজিনা ও তার স্বামী আব্দুল কাদির পলাতক রয়েছেন। 

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সিলেটের ধনাঢ্য এই ব্যক্তি ও তার ছেলে পালিয়ে ভারতে চলে গেলেও গতবছর শেষ দিকে ফিরিয়ে এনে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দুটি মামলায় রাগীব আলীর মোট ১৫ বছরের সাজার রায় আসে।

প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ

১৯৯০ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতি করে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে তারাপুর চা-বাগানের ৪২২ দশমিক ৯৬ একর দেবোত্তর সম্পত্তি রাগীব আলী দখল করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এরপর ১৯৯৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ২০০৫ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি এবং সরকারের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা করেন সিলেট সদরের তৎকালীন ভূমি কমিশনার এসএম আব্দুল কাদের।

এর বিরুদ্ধে রাগীব আলী উচ্চ আদালতে গেলে দীর্ঘদিন পর ২০১৬ সালের শুরুতে তার নিষ্পত্তি হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালুর নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

ওই আদেশের পর ১৫ মে চা-বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।

মামলা হওয়ার ১১ বছর পর সিলেটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত সুপার সারোয়ার জাহান গতবছর ১০ জুলাই দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

এর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলেকে আসামি করা হয়।

আর প্রতারণা মামলায় রাগীব আলী, তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই, জামাতা আবদুল কাদির ও মেয়ে রুজিনা কাদিরকে আসামি করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তারাপুর চা-বাগান পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে বাগানটির দখল নেন রাগীব আলী।

দেশে ফিরিয়ে বিচার

ওই দুই মামলায় গত ১০ আগস্ট রাগীব আলী ও তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সিলেটের আদালত। ওই দিনই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যান তিনি।

গতবছর ১২ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ। ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় লুকিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টার ২৪ নভেম্বর ভারতে গ্রেপ্তার হন রাগীব আলী। ওই দিনই তাকে দেশে এনে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার।

তারাপুর চা-বাগানের বন্দোবস্ত নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় গত ২ ফেব্রুয়ারি রাগীব ও তার ছেলে হাইকে চারটি ধারায় মোট ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয় আদালত।

তাছাড়া পলাতক থাকা অবস্থায় পত্রিকা সম্পাদনাকে প্রতারণা বিবেচনা করে রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইকে গত ৯ মার্চ এক বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও একমাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।