স্বজনদের কণ্ঠে ক্ষোভ

সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যে জোড়া বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2017, 11:02 AM
Updated : 26 March 2017, 02:34 PM

নিহত এক পুলিশ কর্মকর্তার বোন প্রশ্ন রেখেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই যদি এভাবে মারা যান, তাহলে দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া হবে কীভাবে। 

শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানার এক কিলোমিটারের মধ্যে ওই জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত হন পুলিশের দুই পরিদর্শকসহ ছয়জন। র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধানসহ আরও অন্তত ৪৩ জন আহত হন বিস্ফোরণে।

নিহত পুলিশ র্কমর্কতারা হলেন- জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর।

বাকি চারজন হলেন, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহমি, কলেজছাত্র অহিদুল ইসলাম অপু ও নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার শহীদুল ইসলাম ও ছাতকের দয়ারবাজার এলাকার কাদিম শাহ।

রোববার সকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের অনেকেই দিশেহারা।

হাসপাতালের মর্গে কথা হয় পরিদর্শক মনিরুল ইসলামের ভাই সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। 

আবেগতাড়িত সাইফুল অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত সদস্য থাকার পরও জঙ্গিরা হামলা চালাতে পেরেছে ‘গাফিলতির কারণে’।  

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “আমার ভাই ঢাকায় ট্রেনিং করতে গেছে। গতকাল বিকেল ৫টায় তাকে ঢাকা থেকে আনা হল। এখানে র‌্যাব ছিল, সেনাবাহিনী ছিল। ওরা আজ তিন দিন ধরে কী করছে?”

মনিরুলের বোন দিল আফরোজ রোজি বলেন, তার ভাইয়ের একটি মেয়ে আছে। তেমন কোনো সঞ্চয় তিনি রেখে যাননি। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে তার পরিবার।  

“আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, আমাদের নিরাপত্তা নাই। প্রশাসন আমার ভাইয়ের নিরাপত্তা দিতে পারে নাই। পুলিশ কী করে নিরাপত্তা দেবে?”

নিহতদের মধ্যে শহীদ ও কাদিম দুই বন্ধু ডেকোরেটরের ব্যবসা করেন। এক অনুষ্ঠানের কাজ পেয়ে শনিবার তারা শিববাড়িতে গিয়েছিলেন বলে কাদিমের এক আত্মীয় হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান।

শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা জঙ্গি আস্তানা ঘিরে অভিযান শুরু করার পর সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। এর পরপরই কাছের পাঠানপাড়ায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পাওয়া যায়।

বিস্ফোরণের শব্দ শুনে অভিযানস্থল থেকে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা সেখানে ছুটে যান। শিববাড়ির মূল সড়ক থেকে ওই জঙ্গি আস্তানার দিকে যে রাস্তাটি গেছে, তার কাছেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে।

কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বিস্ফোরণের বিস্তারিত না বললেও আহত গুলজার আহমেদের কথায় ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।

ওসমানী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলজার বলেন, লুঙ্গি পরা এক লোক হাতে একটি কালো পলিথিন নিয়ে ওই স্থানে গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে পলিথিনে কী আছে জানতে চান। উত্তরে ওই ব্যক্তি বলেন, ভেতরে ‘লাল শাক’। এর পরপরই বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা এলে দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে।

এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে এমন হামলা হল- সেই প্রশ্ন তুলেছেন নিহত কলেজছাত্র অপুর চাচা মো. শাহীন।

তিনি বলেন, “এত পুলিশ, আর্মি, র‌্যাব… তারপরও কীভাবে এত লোক মারা গেল? এ ঘটনার সুবিচার হোক, আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।”

তবে সিলেটের পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলছেন, বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো গাফিলতি ছিল না। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে তারা কাজ শুরু করেছেন।

“এ ব্যাপারে সবকিছু খতিয়ে দেখছি আমরা। আমাদের কোনো গাফিলতি অবশ্যই ছিল না। কারণ প্রত্যেকেই জানেন, আমরা সেখানে ডিউটিতে ছিলাম। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বের করা হবে।”

হামলার পর নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, “এক্সট্রা কেয়ার অবশ্যই নিয়েছি, টহল বাড়িয়েছি। তল্লাশি চৌকিও বাড়ানো হয়েছে।”

গোলাম কিবরিয়া জানান, নিহত ছয়জনের লাশেরই ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। দুই পুলিশ কর্মকর্তার লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

দুপুরে সিলেট পুলিশ লাইনসে জানাজা শেষে পরিদর্শক মনিরুলের মরদেহ নোয়াখালীতে এবং পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছরের মরদেহ সুনামগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।