চার দিন ধরে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে রোগীদের দুর্ভোগের প্রেক্ষাপটে সোমবার বগুড়ার ওই চার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা স্থগিত করা হয়।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা স্থগিত করা হয়েছে- মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি দেখার পর সন্ধ্যায় কাজে ফিরেছেন বগুড়াসহ সব মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ বা ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠকে চিকিৎসকরা ক্ষমা চাওয়ায় শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানালেও আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র বলেছেন, তারা কারও কাছে ক্ষমা চাননি, আন্দোলন করে দাবি আদায় করেছেন।
এই কর্মবিরতির শুরুটা হয়েছিল গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জেলা সিরাজগঞ্জের এক রোগীর স্বজন নির্যাতিত হওয়ার পর।
নির্যাতনের ওই ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। নির্যাতনে অভিযুক্ত শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের পাল্টা মানববন্ধনে থাকা একটি প্ল্যাকার্ড নিয়েও সমালোচনা ওঠে। তাতে লেখা ছিল- ‘তুমি যদি মানুষ হতে, হতাম ডাক্তার মশাই। তুমি যে ভাই পশু বনের, আমি যে তাই কসাই’।
তখন বিষয়টি তদন্তে নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; এরপর বগুড়া মেডিকেলের চার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের ইন্টার্নশিপ ছয় মাস স্থগিতের আদেশ হয় গত ২ মার্চ।
এর পরপরই বগুড়া মেডিকেলের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ করে দেয়। তাদের সমর্থন জানিয়ে একই কর্মসূচিতে নামে অন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত শিক্ষানবিশরাও।
তাদের প্রতি সমর্থন জানায় চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপ।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধর্মঘটের বিরোধী স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম শিক্ষানবিশদের এই কর্মসূচি অগ্রহণযোগ্য বলেছিলেন দুদিন আগেই, অবস্থান থেকে না সরার কথাও বলেছিলেন তিনি।
কিন্তু ধর্মঘটে রোগীর দুর্ভোগের প্রেক্ষাপটে সোমবার সকালে ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজের বাড়িতে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের প্রতিনিধি, চিকিৎসক নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন তিনি। এতে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগও ছিলেন।
বৈঠকের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বৈঠকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রতিনিধিগণ সার্বিক পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসাবে মন্ত্রীর কাছে অভিভাবকসম ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন তারা।”
“মন্ত্রী চিকিৎসকদের সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এসময় তিনি সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি বন্ধ করতে চলমান সঙ্কট দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে সকল পক্ষকে ধৈর্যশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বগুড়ার শজিমেক হাসপাতালের চার চিকিৎসকের সাজার আদেশ প্রত্যাহারের আশ্বাস দেন।।”
মন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন বলে মন্ত্রণালয় জানায়।
বৈঠকের পর স্বাচিপ সভাপতি ইকবাল আর্সলান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মন্ত্রীর আশ্বাস পাওয়ার পর বিভিন্ন হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বলে তিনি খবর পেয়েছেন।
তবে তখন ময়মনসিংহসহ কয়েক জায়গায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কাজে ফিরলেও বগুড়া, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বেশির ভাগ জায়গায় কর্মবিরতি চলছিল।
বগুড়ার ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের মুখপাত্র কুতুব উদ্দিন দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শাস্তি মওকুফের লিখিত চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে না।”
খুলনা বিএমএর সভাপতি শেখ বাহারুল আলম বলেন, “শাস্তি প্রত্যাহার করে কাজে চারজনকে বহাল না করা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।”
চট্টগ্রাম ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখনও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি।”
সিরাজগঞ্জের নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজ ইন্টার্ন অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি আশরাফুর ইসলাম শুভ্র বলেন, “কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা না আসায় আমরা এখনও কর্মবিরতি পালন করছি।”
একই কথা বলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ সভাপতি মুশফিক-উজ-জামান আকন্দ, রংপুর ও রাজশাহীর শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নেতারা।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি আশফিকার রহমান শামস বলেন, বগুড়ার চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত তারা অনুসরণ করবেন।
এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় বগুড়ার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের মুখপাত্র কুতুব উদ্দিন হাসপাতাল চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
আন্দোলনকারী সবার পক্ষ থেকে তিনি বলেন, “যেহেতু আমাদের আন্দোলনের সাথে আরও অনেক মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা যোগ দিয়েছিলেন, তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বগুড়া থেকে আমি ধর্মঘটের প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পেলেও নিশ্চিত হতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি আসার পর কাজে যোগ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কুতুব উদ্দিন বলেন, “অযৌক্তিকভাবে চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর তা আজ স্থগিত করা হয়েছে।
“এ সংক্রান্ত একটি চিঠি হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মাসুদ আহসান ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দেওয়ার পর ধর্মঘট কর্মসূচি তুলে নিয়ে কাজে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এখন থেকেই আমরা কাজে যোগ দিচ্ছি।”
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কুতুব উদ্দিন বলেন, “চিকিৎসক সমাজ কারও কাছে ক্ষমা চায়নি। এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল।”
রোগীর স্বজনকে নির্যাতনের প্রমাণ ভিডিওতে দেখা গেছে- বলা হলে তিনি বলেন, “২৬ সেকেন্ডের ভিডিও কখনও মূল ঘটনা ছিল না। অর্ধ দিবসের ঘটনাই ছিল মূল ঘটনা।”
নির্যাতিতের অভিযোগ, তিনি ফ্যান বন্ধ করার জন্য সুইচ খুঁজে না পেয়ে দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলে তিনি রেগে যান। এরপর আরেকজন শিক্ষানবিস চিকিৎসক এসে তাকে মারধর করেন এবং অন্য একটি কক্ষে নিয়ে কান ধরে উঠবস করায়।
“আবেগে হয়ত কিছু হয়েছে,” নির্যাতনের অভিযোগ কিছুটা স্বীকার করে নেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের নেতা কুতুব উদ্দিন।
বগুড়ায় সংবাদ সম্মেলনের পর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ফারহান রহমান বলেন, তারাও কাজে ফিরেছেন।
এরপর অন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কাজে ফেরার খবর আসে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বগুড়া, খুলনা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর প্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম ব্যুরো)