কুনিওর স্বপ্ন ছিল কৃষি উন্নয়ন

জাপানে কৃষি গবেষণা ব্যয়বহুল হওয়ায় কীটনাশক ছাড়াই উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদনে গবেষণার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন কুনিও হোশি। বন্ধুতার সূত্রে রংপুরে এসে গরুর রুগ্‌ণ স্বাস্থ্য দেখে প্রথমেই মন দেন পশুখাদ্য উৎপাদনে। জঙ্গিদের নজরে পড়ে গবেষণার মাঝপথেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হল এই চিরকুমারকে।

রংপুর প্রতিনিধিশাহজাদা মিয়া আজাদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2017, 08:07 AM
Updated : 28 Feb 2017, 08:16 AM

যার মাধ্যমে কুনিও রংপুর এসেছিলেন, সেই এ কে এম জাকারিয়া বালা এক সময় জাপানে থাকতেন। পরে জাকারিয়ার জাপান প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে কুনিওর পরিচয় হয়।

জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার দুই ভাই জাপানে যাওয়ার পর আমি ফিরে আসি। আমার ভাইয়েরা ২০ বছর ধরে টোকিওর তেচিগিতে হোটেল ব্যবসা করেন। ছোট ভাই জামিল শিপন একদিন ফোন করে আমাকে কুনিওর কথা বলেন।

“কুনিও রংপুর আসতে চান। তিনি ২০১১ সাল থেকে রংপুরে যাতায়াত করেন। কিছুদিন থেকে চলে যেতেন। কয়েক মাস পরে আবার আসতেন। ২০১৫ সালের ১৪ মে আসেন শেষবারের মতো।”

কুনিও জাপানেই বাংলা ভাষা কিছুটা শিখেছিলেন বলে জানান জাকারিয়া।

“কুনিও বলেছিলেন, তিনি উত্তর-পূর্ব জাপানের ইওয়াতে জেলার অধিবাসী। সেখানে লেখাপড়া শেষে চলে আসেন তেচিগি। সেটাই ছিল তার জাপানি নিবাস। কুনিও বিয়ে করেননি। তার বাবা-মা জীবিত নেই। ভাই-বোন আছেন কিনা সেটা জানাননি কুনিও।”

কুনিও সব সময় টি-শার্ট ও প্যান্ট পরতেন জানিয়ে জাকারিয়া বলেন, তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। টাকা-পয়সার প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। আর শাক-সবজি ছিল তার প্রিয় খাবার।

কুনিও কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সে সম্পর্কে জাকারিয়া কিছু জানাতে না পারলেও তাকে তার কৃষিবিশেষজ্ঞই মনে হয়েছে।

তিন বলেন, কিভাবে কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদন ও ফলন বাড়ানো যায়, কুনিও এ নিয়ে কাজ করতেন। পোলট্রি খামার নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি এমন পশুখাদ্য নিয়ে গষেণা করতেন যেগুলো দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে অনেক বেড়ে উঠবে।

“এসব ঘাসের বীজ নিয়ে গবেষণা জাপানে অনেক ব্যয়সাধ্য। তাই তিনি বাংলাদেশে এই গবেষণা করতে এসেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।”

জাকারিয়া জানান, তার শ্যালক হুমায়ুন কবীর হীরা ও কুনিও যৌথভাবে দুই একর আট শতক জমি লিজ নেন কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে। ওই গ্রামের শাহ আলমের কাছ থেকে এক বছরের জন্য তারা ৮২ হাজার টাকায় জমিটি লিজ নেন।

হুমায়ুন কবীর হীরা বলেন, “যে জাতের ঘাসটি আমরা প্রথম উৎপাদন করি, জাপানি ভাষায় তার নাম ‘কয়েল’ বলে জানিয়েছিলেন কুনিও।

“কুনিও বলেছিলেন, এই ঘাস একই জমিতে বছরে তিন-চারবার আবাদ করা যায়। প্রতি তিন মাস পর কেটে নতুন করে লাগাতে হয়। এটা দেখতে আখের মতো। তবে রস আখের চেয়ে কম মিষ্টি। এর রস দিয়ে গুড় তৈরি করার কথা ছিল। ওই গুড় মৌচাষে মৌমাছির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আর রস বের করার পর গাছ হবে গরুর খাবার। এটা খেয়ে গরু মোটা-তাজা হয় বলে কুনিও বলেছিলেন।”

আজিজ মিয়া নামে স্থানীয় এক কৃষক বলেন, “কুনিও একদিন বলছিলেন, জাপানে এ ঘাসটি ৫-৬ ফুট লম্বা হয়, রংপুরে ১০-১২ ফুট হওয়ায় তিনি খুব খুশি ছিলেন।”

কুনিও খামারে এসে ঘাস কতটা লম্বা হয়েছে তা মাপতেন বলে জানান আজিজ মিয়া।

কুনিও কখনও কখনও নিজেই নিড়ানি দিতেন বলেও তিনি জানান।

কুনিওর মৃত্যুর দিন রাতেই হীরাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে কয়েক দফায় ২৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শেষ পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডে জেএমবির সম্পৃক্ততা পাওয়ায় হীরাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

হীরা বলেন, “কুনিও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা আছে বলে পুলিশ যখন আমাকে গ্রেপ্তার করে তখন আমি হকচকিত হয়ে যাই। আমি কাউকে খুন করতে পারি বলে পুলিশ মনে করল! আর কুনিওর মতো একজন বন্ধু!

“এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাকে যেভাবে হয়রানি করা হয়েছে তা কোনো দিন ভুলব না।”

কুনিও রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া জাকারিয়ার বাড়িতে থাকতেন। তাকে আপন করে নিয়েছিল মুন্সিপাড়ার মানুষ।

ওই এলাকার ব্যবসায়ী সাবেক রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান কাজী মো. জুন্নুন বলেন, “পাড়ার লোকদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন কুনিও। প্রতি সন্ধ্যায় পাড়ায় হাঁটাহাঁটি করতেন।

“ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর স্থানীয় কেরামতিয়া জামে মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে যেতেন। সবাইকে সালাম দিতেন। কেউ সালাম দিলে তা গ্রহণ করতেন।”

একই এলাকার মুদি দোকানি হযরত আলী বলেন, “প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার দোকানে আসতেন। আমাকে সালাম দিতেন। আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার পরামর্শ দিতেন। প্রতিদিন দুই হালি কলা কিনতেন। সেই মানুষটির হত্যা খবর পেয়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।”

স্থানীয় কেরামতিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাহেল, মিথুনসহ কয়েকজন জানায়, কুনিও তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, চকলেট কিনে দিতেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় তাদের নানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন।

“শুনে আমরা খুব মজা পেতাম,” এমনই ছিল মিথুনের অনুভূতি।  

মৃত্যুর আড়াই মাস আগে ১৫ জুলাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নাম নিয়েছিলেন কুনিও।

যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির কাছেই মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদ।

মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেন বলেন, “আমার কাছেই কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন জাপানি কুনিও। এর পর থেকে তিনি নিয়মিত নাজাম আদায় করতেন। ধর্মীয় বই পড়তেন। বই পড়ার পর তিনি বলতেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম।”

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় ৬৬ বছর বয়সি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।

মৃত্যুর পর ঢাকার জাপানি দূতাবাসের অনুরোধে ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সিপাড়া কবরস্থানেই কুনিওকে দাফন করে স্থানীয় প্রশাসন। কবরস্থানের লাশ দাফনের নিবন্ধ খাতায় গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নামটাই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

কুনিও হত্যামামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা জানান, কুনিওর মৃত্যুর পর পুলিশ তার মানিব্যাগ থেকে পাসপোর্ট উদ্ধার করে। পাসপোর্ট থেকে জানা যায়, তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ৩১ মে। সেই হিসেবে তার বয়স ৬৬ বছর।

মঙ্গলবার রংপুরের বিশেষ জজ আদালত কুনিও হোশি হত্যা মামলার রায় দেবে।

মঙ্গলবার রংপুরের বিশেষ জজ নরেশচন্দ্র সরকার দুই বছর আগের চাঞ্চল‌্যকর এ হত‌্যামামলার রায় ঘোষণা করেন। নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।