বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে ‘গাঁজা বিক্রেতা সাজিয়ে’ কারাগারে

লালমনিরহাটে এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে মাদক মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী।

লালমনিরহাট প্রতিনিধিআনিছুর রহমান লাডলা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2017, 06:54 AM
Updated : 25 Feb 2017, 06:55 AM

তবে পুলিশ বলছে, ওই ব্যক্তিকে গাঁজার ব্যাগসহ আটক করা হয়েছে।

মিজানুর রহমান মঞ্জু (৩২) কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে।

কালীগঞ্জ থানার এএসআই বসন্ত রায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুকে এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে তার নামে মাদক মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠান।

মঞ্জুর মা মাহিলা বেগম মিলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় ১২ বছর বয়সে মাথায় আঘাত লেগে মঞ্জুর বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাকে প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দিয়েছেন ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’র সনদ।

“ডাক্তার-কবিরাজ দেখালেও মঞ্জু সুস্থ হয়নি। অভাবের কারণে ভাল ডাক্তারের কাছেও যাওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে খুব বেশি সমস্যা হয়। তখন পল্লীচিকিৎসক ইনজেকশন দিয়ে টানা দুই-তিন দিন ধরে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। তার নাওয়া-খাওয়াসহ কোনো কিছুরই ঠিক নাই। প্রায়ই এখানে-ওখানে চলে যায়। আমিই তাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে জোর করে ধরে এনে যত্ন করি। পুলিশ কয়, সেই ছেলে নাকি গাঁজার ব্যবসা করে।”

মাহিলার অভিযোগ, পুলিশ তার ছেলেকে ‘কোনো অসৎ উদ্দেশে গাঁজা বিক্রেতা সাজিয়ে’ গ্রেপ্তার করেছে।

এদিকে অভাবের কারণে তিনি ছেলের জামিনের জন্য আদালতে আবেদনও করতে পারেননি।

মঞ্জুর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা বলেন, গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে তাদের বাড়িতে এসে মাটি কাটার কাজ করার জন্য মঞ্জুকে ডেকে নেন ওহিদুল ইসলাম ডালুর ছেলে রাখি।

“এর ঘণ্টাখানেক পরে আমরা শুনতে পাই, ডিবি পুলিশ রাখির বাড়ি থেকে মঞ্জুকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর ঘটনা জানতে কালীগঞ্জ থানায় মঞ্জুর পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেও তার সাথে দেখা করতে দেয়নি।”

শ্রীখাতা গ্রামের সাইকেল মেরামতকারী কান্তেস্বর বর্মণ বলছেন, “মঞ্জু পাগলাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে আসেন এএসআই বসন্ত রায় ও আশরাফু নামে এক ব্যক্তি। এএসআই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি তাকে চিনি কিনা।

“আমি বললাম, চিনি তো। মঞ্জু পাগলা। সারাদিন কোদাল ঘাড়ে এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়ায়। আর একে-ওকে বলে, ‘মোক কামোত নিমেন (আমাকে কাজে নেন)।’ এমন কথা শোনার পরও ওরা পাগলাকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে চলে যায়। ঘণ্টাখানেক পরে এএসআই আবার এসে আমার পাশের দোকানদার নূর মোহাম্মদ ওরফে মিস্টারের কাছে সই চায়। উনি সই দিতে না পারায় আমার কাছে এসে সই চায়। আমি সই দিতে পারব না বললে আমাকে হুমকি দিয়ে এএসআই বলেন, ‘আমাকে চিনো? আমি দারোগা।’ পরে আমাকে মামলায় আসামি করার হুমকি দিয়ে চলে যায়।”

নূর মোহাম্মদ মিস্টার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঞ্জুর হাতে লাগানো হ্যান্ডকাপ পাকড়াও করে রেখেছিলেন এএসআই বসন্তের সঙ্গী আশরাফুল।

“আশরাফুল মোটরসাইকেল কেনাবেচা করেন। তবে স্থানীয় লোকজন তাকে পুলিশের সোর্স বলেই জানে।”

আশরাফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার দিন আমি কামারপাড়া গেলে এএসআই বসন্ত দাদার সঙ্গে দেখা হয়। তখন উনি আমাকে বলেন, ‘চলেন তো একটু আসি।’ পরে বসন্ত দাদাসহ রাখির বাড়ি গিয়ে দেখি, রাখি ও মঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে।

“মঞ্জুর হাতে একটি ব্যাগ ছিল। বসন্ত দাদা তখন বলল, ‘ওটা কী?’ এ কথা বলতেই রাখি দৌড় দিয়ে পালিয়ে যান। আর ব্যাগসহ মঞ্জুকে আটক করা হয়। আমি আগে জানতাম না, পরে শুনলাম ওই বাড়িটা নাকি রাখির।”

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “মঞ্জুর বাড়ি আমার বাড়ির সাথে। সে ছোটবেলা থেকে পাগল। সবাই তাকে মঞ্জু পাগলা বলে চেনে। সে হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে যায়। কখনও মসজিদে, কখনও কালীমন্দিরে থাকে। তার প্রতিবন্ধী কার্ডও আছে।

“এমন একজন পাগলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনে আমি এক দারোগাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম যে সে একটা প্রতিবন্ধী মানুষ। তবুও পুলিশ তাকে নাকি মাদক মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।”

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম খন্দকার বলেন, “মঞ্জু মানসিক প্রতিবন্ধী। সে মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকসেবী কোনোটাই না - এটা সবাই জানে। সে পথেঘাটে, মসজিদ-মন্দিরে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যা পায় তাই খায়। তাকে এভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে মাদকের মামলায় জড়ানো ঠিক হয় নাই।”

মঞ্জুর গ্রামে ও আশপাশের এলাকায় খোঁজ নিতে গেলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ‘পাগলা মঞ্জুকে’ কারাগারে রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

শ্রীখাতা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আনসার-ভিডিপির সদস্য বলেন, “মঞ্জু পাগলা কখনও কোদাল, কখনও টুকরি ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার মাঝে মাঝে বাঁশ ঘাড়ে করে সাড়া উপজেলায় ঘুরে বেড়ায়। সে মাদক বিক্রেতা হতেই পারে না।”

শ্রীখাতা গ্রামের বৃদ্ধ হরিশংকর বলেন, “মঞ্জু আগে ভাল ছিল। বহুদিন আগে তার ব্রেন শর্ট হয়। তাকে গাঁজার সাজানো মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।”

আদর্শপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি সাত বছর ধরে এই মসজিদে আছি। প্রায় প্রতিদিন ফজরের আজানের সময় এসে দেখি মসজিদের বারান্দায় মঞ্জু শুয়ে আছে। সে একটা পাগল। সে কোনো ব্যবসা করা তো দূরে, কোনো দিন কোনো নেশা পর্যন্ত করেছে বলে মনে হয়নি।”

দলগ্রাম ইউনিয়নের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি আলহাজ আব্দুল জব্বার বলেন, “মঞ্জু একজন প্রতিবন্ধী। তাকে কেন পুলিশ গ্রেপ্তার করল তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ থানার এএসআই বসন্ত রায় বলেন, “মঞ্জুকে মাদকের ব্যাগসহ আটক করা হয়েছে। তাই তার নামে মাদক মামলা দায়ের করা হয়েছে।”

ওসি মকবুল হোসেন বলেন, “মঞ্জু প্রতিবন্ধী কিনা তা আমি জানি না।”

মঞ্জুর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা লালমনিরহাট পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, “তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”