শাহজাদপুরের মেয়র মিরুর মুক্তিযোদ্ধা সনদে ‘সন্দেহ’

সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলার প্রধান আসামি বহিষ্কৃত আ্ওয়ামী লীগ নেতা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিজ দলের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধারা।

ইসরাইল হোসেন বাবু সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2017, 01:08 PM
Updated : 10 Feb 2017, 01:25 PM

শুক্রবার দুপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সাংবাদিক শিমুলের স্ত্রীর কাছে চাকরির নিয়োগপত্র হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এমপি হাসিবুর রহমান স্বপন সাংবাদিকদের বলেন, আগামীকাল (শনিবার) উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই অনুষ্ঠানেই মিরুর মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গ ও সনদের বিষয়ে সিদ্বান্ত হবে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল।

এ ঘটনায় মিরুকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। আর পুলিশ এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছে মিরুসহ আটজনকে।

সাংবাদিকদের এমপি স্বপন বলেন, গত সাত বছরে দলের কোনো কার্যক্রমে মিরুকে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে দলের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব বা গ্রুপিং থাকতে পারে না। গত মেয়র নির্বাচনে পৌর আওয়ামী লীগ নেতা ভিপি আব্দুর রহিম তৃনমূলের একক সমর্থক পেলেও অদৃশ্য ক্ষমতায় কেন্দ্র থেকে মেয়র মনোনয়ন বাগিয়ে এনেছিলেন মিরু।

এর আগে শিমুলের জানাজার নামাজের আগে সমাবেশে বক্তব্যে এমপি স্বপন বলেছিলেন, শটগান দিয়ে গুলি করার ছবি তোলার অপরাধে টার্গেট করে মেয়র মিরু সাংবাদিক শিমুলকে গুলি করে হত্যা করেছে।

ঘটনার পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত সংঘর্ষের ভিডিওতে মেয়র ও তার ভাইয়ের হাতে অস্ত্র দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে স্বপন বলেন, “আমরা প্রত্যক্ষদর্শীর প্রাপ্ত তথ্য থেকে মেয়রকে অভিযুক্ত করেছিলাম। বৈধ ও অবৈধ সকল অস্ত্র উদ্ধারের পর পরীক্ষা করলেই প্রকৃত সত্য বেড়িয়ে আসবে।”

সাংবাদিক শিমুল হত্যার পর সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহজাদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার বিনয় পালও মিরুর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেন, “মিরু মুক্তিযোদ্ধা নন; কিন্তু ভূয়া জন্ম নিবন্ধনে বয়স কমিয়ে জাল-জালিয়াতি করে ২০১৩ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হন, যার গ্রেজেট নম্বর ১৯৪৬। পরে বিষয়টি তৎকালীন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও ভাতা বিতরণ কমিটির সভাপতির নজরে আসলে মিরুর ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছাই অনুষ্ঠানে বিষয়টি প্রমাণ হবে। এজন্য তাকে শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিনয় পাল।

রুপ গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আজাদ শাহনেওয়াজ ভূইয়া বলেন, “মিরু কোথায় যুদ্ধ করেছে তা আমরা কেউ জানি না। ১৯৭১ সালে তার বয়স ১৩ বছরের কম ছিল।”

শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শফিকুজ্জামান শফি বলেন, বাবার চাকরির সুবাদে মিরুর শৈশব ও স্কুল জীবন কাটে পাবনায়। এসএসপি পাশের পর যোগ দেন তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সিগন্যাল কোরের ওয়্যারলেস অপারেটর পদে।

“সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে শৃঙ্খলা পরিপন্থি আচরণ করে চাকরি থেকে পালিয়ে আসেন মিরু। গ্রেপ্তার এড়াতে ১৯৭৮ সালে চলে আসেন দাদার বাড়ি শাহজাদপুর পৌর সদরের নলুয়া চরে।”

শফি আরও জানান, এরপর মিরু ১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতাদের হাত ধরে শাহজাদপুর কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। জাসদ ছাত্রলীগের মনোনয়নে ১৯৮১ সালে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হন।

ভিপি হওয়ার পর একটি ঘটনায় কলেজের অধ্যক্ষকে তার অফিস কক্ষে তালাবন্ধ করে রাখার অপরাধে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে শপি জানান।

শাহজাদপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম জানান, ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদের মনোনয়নে মশাল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মিরু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এরপর পৌর নির্বাচনে আমার সাথে দুইবার এবং হাসিবুর রহমান স্বপনের (সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের বর্তমান এমপি) সঙ্গে একবার পরাজিত হন।

১৯৯৫ সালে বিএনপিতে যোগ দিলেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে মেনে না নেওয়ায় দল ছাড়তে বাধ্য হয়ে পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বলে নজরুলের ভাষ্য।

আওয়ামী লীগেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ১৯৯৬ ও ২০০৪ সালে দুবার দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার সহযোগিতায় মিরু আবার দলে ফেরেন বলে শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শফি জানান।

এরপর ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হন। গত বছর ২০ মার্চ পাশ হওয়া জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান মিরু।

গত ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা বিজয় মাহমুদকে তার ছোট ভাই হাফিজুর রহমান পিন্টু মারপিট করলে দলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করেন। তখন মেয়র মিরু ও তার আরেক ছোট ভাই হাবিবুল ইসলাম মিন্টুর হাতে মটগান ধেকা যায়। শটগানের গুলিও হয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল গুলিতে আহত হয়ে পরদিন মারা যান।

এ ঘটনায় ইতিমধ্যেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন তার দুই ভাই পিন্টু এবং মিন্টুও।