কিশোরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ে অনিয়মের অভিযোগ

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বছাই কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

মারুফ আহমেদ কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2017, 11:01 AM
Updated : 4 Feb 2017, 11:07 AM

গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলে।

যাচাই বাছাইয়ের পর গত ২৬ জানুয়ারি তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকায় আগে গেজেটভুক্ত ও নতুন আবেদনকারী ২৯৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪৮ জনকে রেখে ২৪৬ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আসাদুল্লাহকে সভাপতি ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসউদকে সদস্য সচিব করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি এ যাচাই-বাছাই কাজ করে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সদর উপজেলা কমান্ডার মো. মতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি ভূপাল চন্দ্র নন্দী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আবু বক্কর ছিদ্দিক, জামুকার প্রতিনিধি মফিজ উদ্দিন ও জেলা কমান্ডের প্রতিনিধি বাশির উদ্দিন ফারুকী।

তালিকা প্রকাশের পর এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা জানান, লাল মুক্তিবার্তায় তালিকায় অন্তর্ভুক্তরা ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কিন্তু তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করেছেন, গেজেটভুক্ত আছেন, সরকারি চাকরি গ্রহণের সময় ঘোষণা দিয়েছেন, যাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরিত সাময়িক সনদপত্র ও কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দেওয়া সনদপত্র আছে তাদের যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনা হয়েছে।   

ডা. সুকেশ চন্দ্র রায়

জেলা শহরের বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত (ম. ৮২৭৮৬) ডা. সুকেশ চন্দ্র রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটি তার কোনো কাগজপত্র দেখেনি। তাকে এক মিনিটও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তিনি যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন, তালিকা প্রকাশের শিটে আবেদনপত্র ছাড়া বাকিগুলো জমা দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

“আমাকে কোনো প্রশ্নই করা হয়নি, তাহলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে যাচাই-বাছাই করা হলো?”

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের বড়ছড়া ক্যাম্পে চলে যান। পরে সেখানে পানছড়া, মনাই ও বালাট ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে তার দেখা হয়। তখন বিভিন্ন ক্যাম্পে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন বালাট ক্যাম্পের জয়বাংলা কার্যালয়ে গেলে তাকে এমএনএ আবদুল কদ্দুস মোক্তার রণাঙ্গনে না গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। সেখানেই তিনি ছয়-সাত মাস আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেন।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে সদর উপজেলার গাগলাইল গ্রামে তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং মালামাল লুটপাট করে রাজাকাররা। বিশাল ভূ-সম্পত্তিও বেদখল হয়ে যায়, যা আজও ফেরত পাননি তিনি।

“তবু একটা শান্তি ছিল আমি মুক্তিযোদ্ধা। এখন সেই শান্তিটুকুও কেড়ে নিতে চাইছেন আমার সহযোদ্ধারা। এ কষ্ট সহ্য করা খুবই কঠিন।”

মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত আরেকজন মোহাম্মদ রুকন উদ্দিন বলেন, “মুক্তিবার্তা সনদ, সাব সেক্টর কমান্ড সনদসহ যেসব সনদপত্র দরকার সবই উত্থাপন করা হয়েছে কমিটির সামনে। তার সাক্ষীরাও উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করেনি কমিটি। অন্যায়ভাবে তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে কমিটি।”

সাবেক স্কুলশিক্ষক মো. শাখওয়াত হোসেন বলেন, তিনি সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ছিলেন অন্তত ১৫ বছর। তাকেও যাচাই বাছাইয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ মেমোরিয়াল

তিনি বলেন, মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মুসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে সিলেট অঞ্চলের তাহেরপুরসহ বিভিন্ন সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নেন তিনি। তাহেরপুরের যুদ্ধে তাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আবদুর রশিদ।

“আমিসহ ১২৫ জন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে একসঙ্গে নিকলীর করগাঁও হয়ে টেকেরঘাট যাই। আমার মতো রণাঙ্গনের এক যোদ্ধাকে কীভাবে তারা বাদ দেয়?

যাচাই-বাছাই কমিটি তাকে তেমন প্রশ্ন করেনি। তার সাক্ষীদেরও ডাকেনি বলে তার অভিযোগ।

উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের গাগলাইল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত নূরুল হক ভূঁইয়া, সুন্দর আলী, হাজিপুরের ফজলুর রহমান, মাইজখাপন ইউনিয়নের হাজিরগল গ্রামের আবুল হাশেম ও এম এ গনি অভিযোগ করেন, যাচাই-বাছাই কমিটি তাদের কোনো সাক্ষীকে জেরা করেনি। অথচ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় এ কাজটি ছিল বাধ্যতামূলক।

সুন্দর আলী বলেন, “তালিকা থেকে বাদ না দিয়ে তারা যদি গুলি করে মেরে ফেলত তা হলেও এত কষ্ট হতো না আমার।” 

নূরুল হক বলেন, “আমারে জ্যান্ত কবর দিয়ালছে বাছাই কমিটি।”

নতুন তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করে বাদ পড়েছেন আবদুল করিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহচর হিসেবে কাজ করেছি আমি। সৈয়দ নজরুলের নির্দেশে বিভিন্ন ক্যাম্পের তথ্য-উপাত্ত, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার তথ্য দিতাম তাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের কাজও করেছি।

“ইতিপূর্বে তালিকাভুক্তির জন্য তেমন আগ্রহ না থাকলেও এবার তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেছিলাম। তবে যাচাই-বাছাই কমিটি স্বীকৃতি দেয়নি।”

মো. আসাদুল্লাহ

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করে বাদ পড়া আশুতোষ ভৌমিক বলেন, “আমি আসামের সেলুনিবাড়ি প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ৫ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব সেক্টরে মেজর এম এ মোতালিবের অধিনায়কত্বে দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।”

অভিযোগের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য সচিব সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, ভারতে গিয়ে যারা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাচাই-বাছাইয়ে তাদের আমলে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। কারণ উনারা সবাইকে ভালো করে চিনেন জানেন।

যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আগে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাছাই কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে না পারার কারণেই অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তবে যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিব দুজনেই জানান, যারা বাদ পড়েছেন তারা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আপিল করতে পারেন। সেখানে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে।