বনবিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন আসাম সরকারের আসাম ফরেস্ট এটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে।
১২৫০ হেক্টর জমিতে গড়ে ওঠা লাউয়াছড়ার আগের নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ রিজার্ভ ফরেস্ট। ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই এটাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার।
এর মূল অংশ পড়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়। রাজধানী থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে এ বনের অবস্থান।
লাউয়াছড়া বিটের আওতাভুক্ত এই জাতীয় উদ্যান জানকিছড়া ক্যাম্প, লাউয়াছড়া ক্যাম্প ও বাঘমারা ক্যাম্পের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কান্তি দো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার সেগুন, লোহাকাঠ, চাপালিশ, জারুল, কদমসহ নানা মূল্যবান গাছের চারা রোপন করে।
বর্তমানে এখানে চাপালিশ, সেগুন, লোহাকাঠ, জারুল, বট, পাকুড়, ডুমুর, বহেরা, আমলকি, হরিতকি, গর্জন, ছাতিয়ান, শিমুল, কদম, আম, কাঁঠাল, তুন, কড়ই, রক্তন প্রভৃতি বৃক্ষ ছাড়াও আওয়াল, বনাকসহ নানা জাতের স্থানীয় প্রজাতির গাছসহ অন্তত ১৬৭ প্রজাতির লতা ও গুল্ম রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতরে সীমানা ঘেঁষে ও পশ্চিম ভানুগাছ বনের ভিতরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে দুইটি গ্রামে বাস করে খাসিয়ারা। জানকিরছড়ার ডলুবাড়িতে রয়েছে টিপরা আদিবাসীর বসতি। খাসিয়ারা খ্রিস্টান, ত্রিপুরারা হিন্দু এবং টিপরারা মনিপুরি সম্প্রদায়ের। এছাড়া মুসলমানও রয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীর মধ্যে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছে। এরমধ্যে ছয় ধরনের বানর জাতীয় প্রাণী- উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, ক্যাপড্ লেংগুর, পিগ টেইল ম্যাকাক, ফ্যারিজ লিফ মাংকি ও সাধারণ বানর। রয়েছে মায়া হরিণ, কমলা বুকওলা কাঠবিড়ালি, শেয়াল, মেছো বিড়াল, বন্যশূকর, সজারু, সিভেট, জংলী বিড়াল, বেজী ইত্যাদি।
২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, যার মধ্যে অজগর, গোখরা, পিট ভাইপার ও মনিটর লিজার্ড উল্লেখযোগ্য। ছয় প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বন কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে লাউয়াছড়ার প্রধান শত্রু হলো ভূমি দখল, বৃক্ষ উজার, বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া রেল লাইন, পাকা সড়ক ও খোলা বৈদুতিক লাইন।
ট্রেনের শব্দ বনের পরিবেশ দূষণ করে এবং ট্রেনে কাটা পড়ে প্রায় সময়ই বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। এছাড়া রেল লাইনের পাশের বৃক্ষগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে ট্রেন লাইনের পাশের গাছগুলো কাটতে হয়।
একই অবস্থা বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কেও। প্রতিনিয়ত গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা পড়ছে মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, সাপ, হিমালয়ান পাম সিভেট, গন্ধগকুলসহ বিভিন্ন প্রাণী।
আর ৩৩ হাজার কেভির বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রায় সময়ই মারা যায় বিপন্ন প্রাণী উল্লুক, হনুমান ও বিভিন্ন প্রজাতির বানর।
“ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিন্ধান্ত হয়েছে যে, সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত লাউয়াছড়া পাকা সড়ক বন্ধ থাকবে। এই সময়ে বনের পাশ দিয়ে নুরজাহান চা বাগানের ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় যানবাহন চলাচল করবে।”
তবে নুরজাহান চা বাগানের ওই রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা ও সরু থাকায় তা এখনও বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে তবিবুর জানান।
মিহির কান্তি দো বলেন, জাতীয় এই উদ্যানের সুনির্দিষ্ট সীমানা চিহ্নিত না থাকায় প্রতিনিয়ত ভূমি সংকুচিত হওয়ার খবর তাদের কাছে আসে। তারা তা রক্ষার চেষ্টা করে চলছেন। ইতিমধ্যে বনের ভিতর থেকে বেশ কিছু লেবু বাগান তারা উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাঘমারা এলাকায় ভূমি জবরদখলের প্রবনতা খুব বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বেশ কিছু বসতি সেখানে হয়ে গেছে। অন্যত্র জায়গা দিয়ে এদের অপসারণও খুব জরুরি।
লাউয়াছড়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোছাদ্দেক আহমদ মানিক বলেন, বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বনবিভাগের পাশাপাশি তারাও কাজ করছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্বুদ্ধকরণ সভা, অতিরিক্ত পাহারাদার নিযুক্তি, পর্যটকদের শৃঙ্খলা আনয়নসহ বিভিন্ন কাজ তারা করছেন। বনের ভিতর বেশকিছু ফলজ বৃক্ষের চারাও রোপন করেছেন।
সাংসদ আব্দুস শহীদ বলেন, লাউয়াছড়া বন রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি এর চারপাশের জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
শ্রীমঙ্গল পৌর মেয়র মহসীন মিয়া মধু ও কমলগঞ্জ পৌর মেয়র জুয়েল আহমদ বলেন, লাউয়াছড়া বনের কারণে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। এ দুই উপজেলা আজ সারাদেশে এ কারণে পরিচিত। এর সুবাদে দুই উপজেলায় গড়ে উঠেছে শত শত রিসোর্ট ও পর্যটন নির্ভর ব্যবসা।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, চোখের সামনেই পাল্টে গেছে এই বন। এই বনেই তিনি দেখেছেন ভাল্লুক, চিতা বাঘ, মেছো বাঘ, সজারু, বন রুইসহ অসংখ্য প্রাণী। আজ বনের ভিতরে প্রবেশ করলে আর কিছুই দেখা যায় না।
এর কারণ হিসেবে তিনি দেখছেন গাছ কমে যাওয়া এবং এর ফলে বনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো দিয়ে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। বন্যপ্রাণীর খাবারের জন্য যে বৃক্ষ ও ছোট ছোট কীটপতঙ্গ তাও নেই। তাই প্রাণীরা বিপন্ন তো হবেই।
বহু প্রাণী তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে এই বনে অবমুক্ত করেছেন এবং এখনও করেন।