সরেজমিন তদন্তের প্রথম দিন সোমবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) শেখ হাফিজুর রহমান ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ছাত্র, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, অভিভাবকসহ ১৯ জনের সাক্ষ্য নেন।
বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যান্দী এলাকায় অবস্থিত পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক শ্যামলের কক্ষে বসে বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একটানা সাক্ষ্য নেন তিনি।
লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তিও এদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া তার শাস্তি দাবিতে একদল ব্যক্তিও ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন, তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমানের সমর্থকদের দেখা গেছে।
মঙ্গলবার জেলা সার্কিট হাউজে প্রধান শিক্ষক শ্যামলসহ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে।
পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ১৩ মে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়।
ওই ঘটনার ভিডিওতে ওই শিক্ষককে কান ধরে উঠ বসের নির্দেশ দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে দেখা গেলে তার শাস্তির দাবিও উঠে।
ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়।
আদালতের নির্দেশনায় পুলিশ প্রতিবেদন দিলেও দায়সারা ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে আগামী ৩ নভেম্বরে মধ্যে হাই কোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ওই নির্দেশ পেয়ে সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমান সোমবার নারায়ণগঞ্জে তদন্তে আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার সিএমএম আদালতের দুই হাকিম গোলাম নবী ও মাজহারুল ইসলাম। তাদেরকে সহায়তা করেন নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম শহীদুল ইসলাম।
বিচার বিভাগীয় তদন্তকারীরা প্রথমে প্রধান শিক্ষক শ্যামলের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগকারী দশম শ্রেণির ছাত্রের কথা শোনেন।
এরপর ওই ছাত্রের মা রিনা বেগম, ইংরেজির শিক্ষক উত্তম কুমার ও মাসুম মিয়া, বাংলার শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, গণিতের শিক্ষক মোশারফ হোসেন, ইসলাম ধর্মের শিক্ষক বোরহানুল ইসলাম, সহকারী প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তার, ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ফারুকুল ইসলাম, সদস্য মোবারক হোসেন, বাইতুল আতিক জামে মসজিদের ইমাম মাহমুদুল হাসান, মসজিদের মুয়াজ্জ্জিন আব্দুল হাই এবং সাত শিক্ষার্থীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সেদিন মাইকে ঘোষণা দিয়ে একদল ব্যক্তি শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছিত করার পর বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি তাকে পদচ্যুতও করেছিল।
এরপর দেশজুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের মধ্যে দুই দিনের মাথায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। নিয়মবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করা হয়।
দীর্ঘদিন ঢাকায় চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ৯ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কড়া পুলিশ পাহারায় শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে নগরীর খানপুর এলাকার ভাড়া বাড়িতে দিয়ে যায় পুলিশ।
শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে কথিত নির্যাতিত ছাত্রের মায়ের একটি এবং ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে করা আরেকটি মামলার আরজি নারায়ণগঞ্জের আদালত খারিজ করে দিলেও ওই অভিযোগে তার শাস্তি চেয়ে আসছে একদল।
সোমবার বিচার বিভাগীয় তদন্তের মধ্যে সকাল থেকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবু জাহের, সাধারণ সম্পাদক আকরাম আলী শাহীন, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন প্রধান, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের এই সমর্থকদের সঙ্গে দলটির স্থানীয় একদল নেতা-কর্মী শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের শাস্তির দাবি জানায়।
বিদ্যালয়ের দেয়াল ও সড়কের মোড়ে মোড়ে তারা ‘আল্লাহ-রাসুলকে কটূক্তিকারী নাস্তিক, ছাত্রদের প্রহারকারী ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ শ্যামল কান্তি ভক্তের বিচার চাই’ পোস্টারও লাগায়।
আরও খবর