হুমকি পেয়ে বিশ্ববিদ‌্যালয়ে ফিরেই ‘খুন’ লিপু, সন্দেহে ‘পরীক্ষা জালিয়াত চক্র’

অন‌্যের হয়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জেল খাটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোতালেব হোসেন লিপু হলে ফেরার রাতেই ‘খুন’ হয়েছেন, যার জন‌্য ‘পরীক্ষা জালিয়াত চক্রকে’ সন্দেহ করছেন তার এক সহপাঠী।

বদরুল হাসান লিটনও ইব্রাহীম খলিলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2016, 03:38 PM
Updated : 21 Oct 2016, 04:44 PM

তিন মাস কারাগারে কাটিয়ে মুক্তি পাওয়ার পর ‘পরীক্ষা জালিয়াত চক্রের’ সঙ্গে লিপুর বিরোধে জড়িয়ে পড়ার তথ‌্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের ডাইনিংয়ের পাশের একটি নর্দমা থেকে বৃহস্পতিবার সকালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র লিপুর লাশ উদ্ধার করা হয়। মাথায় আঘাতে তার মৃত‌্যু হওয়ার কথা জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

মতিহার থানার ওসি হুমায়ন কবির বলছেন, লিপুর মৃত‌্যুকে হত‌্যাকাণ্ড ধরে নিয়ে ‘পরীক্ষা জালিয়াত চক্রের’ সঙ্গে তার বিরোধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত চলছে।

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার মকিমপুর গ্রামের দিনমজুর বদর উদ্দিনের ছেলে লিপু গত বছর জালিয়াত চক্রের হয়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ধরা পড়ে ভ্রাম‌্যমাণ আদালতে দণ্ডিত হন।

লিপু এই জালিয়াত চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক সহপাঠী। এ নিয়ে হুমকি পাওয়ার কথা লিপুই তাকে বলেছিলেন বলে জানান তিনি।

লিপু বেশ কিছুদিন ধরেই মোবাইলে হুমকি পাচ্ছিলেন বলে তার বাবা বদর উদ্দিন জানান।

তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হুমকির মুখে মোবাইল ভেঙে ফেলেছিলেন লিপু। তারপরও ভয়ে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইছিলেন না। পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য তারাই জোর করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে মঙ্গলবার বিকালে রাজশাহীতে ফেরেন লিপু।

বদর উদ্দিন বলেন, “মঙ্গলবার সকালেও কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে লিপুকে ফোনে হুমকি দেওয়া হয়। ফোনে কথা বলা শেষে লিপু তার মোবাইল ফোন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। এরপর সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইছিল না। লিপু শুধু বলেছিল, ‘বিপদে আছি’।

“এরপরও ফরম পূরণের জন্য চাপ দিয়েই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাকে থাকতে বলা হয়েছিল।”

তিনি জানান, হুমকির মুখে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর লিপুকে বাইসাইকেলে করে এক কিলোমিটার দূরে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসেন তার চাচা বছির উদ্দিন।

নবাব আবদুল লতিফ হল

যাওয়ার সময় লিপু তার সিম কার্ড ও বাড়িতে থাকা একটি নষ্ট মোবাইল ফোন সেট নিয়ে যায় বলে জানান বদর উদ্দিন।

হুমকির মুখে ওইদিন বাড়ি থেকে গিয়ে লিপু রাজশাহী শহরের কাটাখালি এলাকায় ওই আত্মীয়ের বাসাতেই উঠেছিলেন বলে তার মা হোসনে আরা বেগম জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরদিন বুধবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ফরম পূরণ করে। আগামী ২ নভেম্বর তার দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা ছিল বলে লিপু জানিয়েছিল।”

বুধবার দুপুরের দিকে লিপু তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছিলেন জানিয়ে হোসনে আরা বলেন, “বন্ধুর ফোনে সিম ঢুকিয়ে লিপু আমার সঙ্গে কথা বলে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার রুমমেটের মোবাইল নম্বর দেওয়ার কথা বলেছিল।

“কিন্তু তার রুমমেট মোবাইল নম্বর দিতে রাজি হয়নি। তাই সে নতুন সিম কিনে এবং পুরাতন মোবাইল ঠিক করে নম্বর দিতে চেয়েছিল।”

ফরম পূরণ করে বুধবারই নবাব আব্দুল লতিফ হলে ওঠেন হলটির ২৫৩ নম্বর কক্ষের ছাত্র লিপু, পরদিন সকালে তার লাশ উদ্ধার হয়।

লিপুর মামাতো ভাই মো. সজীবউদ্দিন বলেন, “ওর লাশ যেখানে পাওয়া গেছে ওই জায়গাটা আমরা দেখেছি। লাশের পাশেই একটা পেঁপে গাছ আছে।

“যদি সে উপর থেকে পড়ে যেত, তাহলে সেখানে পেঁপে গাছটার কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া যেত। কিংবা অন্য কোনো উপসর্গ পাওয়া যেত। কিন্তু এসবের কিছুই পাওয়া যায়নি।”

লিপুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে সজীব বলেন, “লিপুর রুমের বাইরে অতিরিক্ত দুই জোড়া জুতা পাওয়া গেছে, যেগুলো ওই রুমের কারও না। আর লিপুর পায়ের একটি জুতা ওর ঘরে পাওয়া গেছে, আরেকটি যেখানে ওর লাশ পাওয়া গেছে সেখানে পাওয়া গেছে।

“এছাড়া লিপু একটু সহজ-সরল ছিল, ভয়ও পেত। এজন্য ওর মাজায় একটা মাদুলি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ওই মাদুলিটা ওর ঘরের মেঝেতে ছেঁড়া অবস্থায় পড়েছিল।”

পরীক্ষার জালিয়াত চক্রটিকে চিনে ফেলার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিপুর ওই সহপাঠী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জালিয়াত চক্রের মাধ্যমে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিয়ে জেল খাটার পর লিপু আমাকে বলেছে, এসব আর সে কখনও করবে না।

“কিন্তু সমস্যাটা হলো লিপু ওই জালিয়াতি চক্রকে চিনে ফেলেছিল। এজন্য তাকে মাঝেমাঝেই হুমকি দেওয়া হত।”

গত বৃহস্পতিবারও রাজশাহীতে একটা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা ছিল জানিয়ে ওই সহপাঠী বলেন, “পরীক্ষার জন্য অনেকেই হলগুলোতে ছিল। ও মঙ্গলবার এসেছে ক্যাম্পাসে। ওই জালিয়াত চক্র তাকে আবার জোর করে থাকতে পারে। সে এতে রাজি না হওয়ায় তাকে মেরে ফেলা হতে পারে।”

ছেলেকে হুমকি দেওয়া হতো বলে জানালেও কারা তাকে হুমকি দিত সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না লিপুর বাবা বদর উদ্দিন।

“আমার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা হুমকি দিত। কেন হুমকি দিত তা জানি না। তবে যারা অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়ায় ছিল তারা হুমকি দিত। তারা কারা তা শুধু আমার ছেলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরাই জানে,” বলেন তিনি।

বদর উদ্দিনের দুই ছেলে, আর এক মেয়ের মধ্যে লিপুই সবার বড়। লিপুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাশাপাশি মেয়েকে ভর্তি করিয়েছেন স্থানীয় কলেজে।

বদর উদ্দিন বলেন, “ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতে সারাদিন পরিশ্রম করি। তাদের চাহিদা পুরণ করতে না পারলেও চেষ্টা করেছি। তারপরও আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলল। আমি ওদের বিচার চাই।”

লিপুর লাশ উদ্ধারের পর ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় হলে মনিরুল ইসলাম নামে তার এক রুমমেটসহ চারজনকে আটক করে থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান মতিহারের ওসি হুমায়ন কবির।

তিনি বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনজনকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মনিরুলকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন‌্য থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে।”