‘নারায়ে তাকবির’ শ্লোগানে গ্রেনেড-গুলি ছোড়ে জঙ্গিরা

নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা চালায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

মজিবুল হক পলাশ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2016, 02:35 PM
Updated : 27 August 2016, 10:14 PM

শহরের পাইকপাড়ার কবরস্থান এলাকার তিন তলা ওই বাড়িটি শনিবার ভোরে ঘিরে ফেলে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস‌্যরা। পরে র‌্যাবসহ অন‌্য বাহিনীগুলোও অভিযানে যোগ দেয়।

শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ ভবনটির ভেতরে ঢুকতে অভিযান শুরু করে। সাড়ে ১০টার দিকে অভিযান শেষের পর জানানো হয়, ওই আস্তানায় পুলিশের গুলিতে ‘নব‌্য জেএমবি’র প্রধান গুলশান হামলার ‘হোতা’ তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন।

অভিযানকালে জঙ্গি আস্তানার তিন তলা ওই বাড়ির মালিক নুরুউদ্দিন দেওয়ান, তার স্ত্রী ও তিন ছেলেসহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, অভিযান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। কাউকে ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। দোকানপাট ও ঘরের দরজা জানালাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযান চলাকালে গোলাগুলি ও গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

ভবনটির পাশের চার তলা ভবনের বাসিন্দা সেলিনা হক বলেন, সকাল ৭টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বাড়ি এসে নক করে। তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে রুমটি তাদেরকে ছেড়ে দিতে বলে। পরে তাদের ফ্ল্যাটের সবাইকে নিচ তলার একটি রুমে নিয়ে রাখা হয়। পুরো ভবনটি পুলিশ ও র‌্যাব ঘিরে রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় অবস্থান নেয়।

“সকাল ৯টার পর থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। আমাদের ভবন বরাবর নরুউদ্দিন দেওয়ানের বাড়ি থেকে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান শোনা যায়। এসময় গ্রেনেড ও গুলির শব্দও শুনতে পাই।”

নুরুউদ্দিন দেওয়ানের বাড়ির তিন তলার ফ্ল্যাটের রান্না ঘরের এক পাশের থাই জানালা খোলা থাকলেও অপর পাশের অংশে তোয়ালে দিলে ঢেকে রাখা হতো সারাক্ষণ। কাউকে দেখা যেত না বলে জানান সেলিনা।

সেলিনার একই ভবনের তৃতীয় তলার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ প্রথমে তাদের ফ্ল্যাটে অবস্থান নিলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়। তিনিও একই রকম শ্লোগান শুনতে পেয়েছেন।

একই ভবনের নিচ তলার টিনের ঘরের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব আরেক ব্যক্তি বলেন, সকাল ৬টার দিকে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। তাদেরকে ঘর থেকে বের না হতে নিষেধ করে দেয়। তাদের ভবনসহ আশপাশের ভবনের বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখা যায়। পুরো এলাকা সিল করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টার পর তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়।

“আমরা কেউ কাজে যেতে পারিনি। গোলাগুলি ও বোমার শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরকম গোলাগুলি ও বোমার শব্দ সর্বশেষ শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়।”

জঙ্গি আস্তানার ভবনটির ৫০ গজ দূরের একটি ভবনের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সকাল ৯টার দিকে তাদের বাড়ির সামনের ফ্ল্যাটের (নুরুউদ্দিন দেওয়ানের বাড়ি, জঙ্গি আস্তানা) ছাদে ওঠে দুই যুবক। তাদের দুজনের কাঁধে ছিল ব্যাগ, একজনের হাতে ছিল রাইফেল অপর একজনের হাতে ছিল পিস্তল।

“তারা আল্লাহু আকবর শ্লোগান দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর গ্রেনেড ছুড়ে মারে ও গুলি করে। তখন অন্যান্য ভবনের ছাদ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে এক যুবক ছাদে পড়ে যায়। অপরজন ঘরের ভেতরে চলে যায়।”

তিনি ওই ফ্ল্যাটের ভেতর আগুন জ্বলতে দেখেন। সেখান থেকে কালো ধোঁয়াও দেখতে পান বলে জানান।

পাইকপাড়া বড় কবরস্থানের খাদেম মোহাম্মদ সাইদুর রহমান জানান, প্রতিদিনের মতো তিনি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কবরস্থানে আসার পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটকায়। পরিচয় দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়। পরে কবরস্থানে ঢুকে নিজের অফিসে বসে থাকেন তিনি। সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান তিনি।

তিনি জানান, কবরস্থানে আসার সময় এলাকার লোকজন জানিয়েছে- ভোর রাত ৩টা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়।

ওই তিন তলা বাড়ির মালিক নুরুউদ্দিন দেওয়ানের স্বজনেরা জানান, ঈদের ২/৪দিন আগে মুরাদ ও রানা নামের দুই ব্যক্তি ৮ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। তারা নিজেদের একমি ল্যাবরেটরিজের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযানে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  গোলাগুলির এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই বাড়ির ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় তারা দুই জঙ্গির লাশ পাশাপাশি দেখতে পান। তাদের বুকের উপর একটি একে ২২ রাইফেল ছিল। তাদের কিছুটা দূরে আরেকটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. ফারুক হোসেন জানান, জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তাদের তিনজনের পরনেই ছিল টি শার্ট এবং জিন্স প্যান্ট। শেষে বাড়ির মালিকসহ ১০ জনকে জিজ্ঞাবাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে ঘটনাস্থলে আইএস বা অন্য কোনো জঙ্গির পোশাক বা অন্যকিছু পাওয়া যায়নি।

অভিযানকালে জঙ্গিরা ফ্ল্যাটের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ধারণা করা হচ্ছে, তারা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে। ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট আলামত সংগ্রহ করার পর লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।”

তিনি বলেন, অভিযানে তিন জন নিহত হলেও অপর দুই জনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। সিআইডির ক্রাইম সিন তাদের হাতের আঙুরের ছাপ সংগ্রহ করেছে। তারা এনআইডি থেকে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করবে।