বন্যায় কুড়িগ্রামে দুর্ভোগ চরমে

কুড়িগ্রাম জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকার দেড় লক্ষাধিক মানুষ বন্যার পানিতে দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে।

আহসান হাবীব নীলু কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2016, 09:09 AM
Updated : 24 July 2016, 09:25 AM

জেলার ৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৩৭টির অধিকাংশ এলাকায় বন্যা হওয়ায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসনের বন্যা পর্যবেক্ষণ দলের প্রধান ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল মোতালিব মোল্লা।

তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে পরপর তিনবার বন্যা হওয়ায় এবং তৃতীয় দফায় স্রোতের গতি বৃদ্ধির কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।

কুড়িগ্রাম শহরের ফেরিঘাট পয়েন্টে রোববার বেলা ১১টায় ধরলা নদী বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বলে তিনি জানান।

অপরদিকে ৪৫টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, তাদের ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে কমপক্ষে ১ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।

উলিপুর উপজেলার হাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন বলছেন, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭টি প্লাবিত হয়েছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার ভেদরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, তার ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

চেয়ারম্যানদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার নদী-তীরবর্তী প্রায় ৪০০ গ্রাম বন্যার পানিতে পুরোপুরি তলিয়ে গেছে।

গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে তারা জানান।

সরজমিনে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দুর্দশার চিত্র দেখা গেছে।

শনিবার দুপুরে উলিপুর উপজেলার দুর্গম মশালের চরের সাহেরা খাতুন ও তার দুই মেয়ে আল্পনা (১৪) ও আমিনা (১২) বের হয়েছিলেন মরিচের সন্ধানে। সকাল থেকে তাদের কিছু খাওয়া হয়নি। বহুকষ্টে ভাত রান্না করলেও তরকারি নেই। ডিঙ্গিনৌকা নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী বৈজুদ্দির বাড়ি। কিন্তু তাদের মরিচ নেই।

“২০০ টাকা মরিচের কেজি। কেনার সামর্থ্য নেই বাহে। রোজার মাস থাকি তিনবারের বানোত কাহিল হামরা। গ্রামত এক সমিতির কাছ থাকি চড়া সুদোত ৫ হাজার টাকা কর্জ নিয়া কোনো রকমে জীবনটা বাঁচি রাখছি। বানের দিন আর শ্যাষ হয় না। হামাকগুলা বাঁচান বাহে। থাকার কষ্ট, খাওন কষ্ট,” বললেন সাহেরা খাতুন।

শুধু সাহেরা খাতুনের পরিবার না, বন্যাকবলিত প্রায় সবার একই অবস্থা।

ওই চরের গৃহবধূ রাশেদা খাতুন (৩৩), শহীদুল ইসলাম (৪২), নবীরন (২৫), চায়না বেগম (৩৫), নূর নাহার (২০), জাহেদুল ইসলামসহ (৩০) সবাই জানান, বন্যার পানিতে আশপাশের সবজিক্ষেত, দোকানপাট সম্পূর্ণ পানির নিচে।

কারও কারও ঘরে চাল থাকলেও জ্বালানির অভাবে রান্না করতে পারছেন না বলে তারা জানান। ফলে এক বেলা শুকনা খাবার খেয়ে উপোস করতে হচ্ছে। শিশুদের নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।

অসুস্থ হলে চিকিৎসা কিংবা ওষুধের ব্যবস্থা নেই এখানে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

সরজমিনে দেখা গেছে, সাহেবের আলগা চর আর বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ১৮টি ওয়ার্ডের সবই প্লাবিত। সীমাহীন দুর্ভোগ মোকাবেলা করছে এসব এলাকার শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ ও নারীসহ সবাই।

ব্রক্ষপুত্র পাড়ের বন্যাকবলিত গ্রাম বালাডোবা, খুদিরকুঠি, পোড়ারচর, মশালেরচর, চরমোহম্মদ, চরফকিরমোহম্মদ, বতুয়াতুলি, আক্কলমামুদ, চিতুলিয়া,  দৈখাওয়া, চেরাগের আলগা, জাহাজের আলগা, চরদুগাপুর, গেন্দার আলগা, কাজিয়ারচর, সুখেরবাতির চর ঘুরে মানুষের চরম দুর্ভোগ চোখে পড়েছে।

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আলমের বাজার এলাকার রহমান (৪৭) ও সরকারপাড়ার আমজাদ (৪৩) ও মিয়াজিপাড়ার কোবাদ ডিলার ঘরবাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান।

একই ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়ার কৃষক ছকমল (৬০) ও শাহেদ আলী (৫৫) জানান, দুই সপ্তা আগে তারা আমনের চারা রোপণ করেছিলেন। তা এখন পানির নিচে। নতুন চারা কেনার সামর্থ্য নেই।

সরকারি সহযোগিতা সম্পর্কে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলছেন, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড পানির নিচে। প্রায় ১৪ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। মাত্র ৪ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য বলে তিনি জানান।

জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন বলছেন, বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

“ইতোমধ্যে দুই দফায় ১০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও ১৯২ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। পুরোদমে বিতরণ শুরু হলে সংকট থাকবে না।”

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সহযোগিতায় সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হচ্ছে।