ঝিনাইদহে পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় গ্রামের মেঠোপথে এক হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করেছে মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2016, 04:42 AM
Updated : 7 June 2016, 04:42 AM

সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ধরনের সঙ্গে মিল থাকায় এ ঘটনার পেছনেও জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন সহকারী পুলিশ সুপার গোপীনাথ কানজিলাল।

মঙ্গলবার সকালে নিহত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৬৯) এক সময় নলডাঙ্গা দুর্গা মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। তিনি সদর উপজেলার করাতিপাড়া গ্রামের মৃত সত্য গোপাল গাঙ্গুলির ছেলে।

পাঁচ মাস আগে ঝিনাইদহে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সমির আলীর মতো আনন্দ হত্যাকাণ্ডেও আইএসের দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ জানিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীটি বাংলাদেশে ছুরি দিয়ে এমন আরও হামলার হুমকিও দিয়েছে বলে সাইট গ্রুপ জানায়।

সকাল ৯টার পর করাতিপাড়ার বাড়ি থেকে সাইকেলে নলাডাঙ্গা গ্রামের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে যাওয়ার সময় মহিষাডাঙ্গা গ্রামে মহিষের ভাগাড় মাঠের ভেতরে আক্রান্ত হন তিনি। এই স্থানটি তার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে।

সহকারী পুলিশ সুপার গোপীনাথ জানান, মোটর সাইকেলে করে আসা তিনজন পুরোহিতের উপর হামলা করে। তারা প্রথমে বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে। জবাই করে হত্যার পর মোটর সাইকেলে করে চলে যায়।

“ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে জঙ্গিরা এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।” 

ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, “নির্জন মাঠের মধ্যে পুরোহিতকে খুন করে পালিয়ে যায়। এসময় মাঠে কাজ করা কৃষকরা টের পেয়ে চিৎকার দিলে গ্রামবাসী ছুটে আসে। এরপর পুলিশকে খবর দেয়।”

দেশের বিভিন্ন স্থানে একই কায়দায় হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে পুরোহিত খুনের খবর পেয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।

মোটর সাইকেল আরোহী খুনিদের শনাক্ত করতে জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চৌকি বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করা হচ্ছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা আজবাহার।

স্থানীয়রা জানায়, আনন্দ গোপাল এক সময় নলডাঙ্গা দুর্গা মন্দিরের পুরোহিত থাকলেও এখন নির্দিষ্ট কোনো মন্দিরে কাজ করতেন না। বিভিন্ন মন্দিরে ও বাড়িতে পূজারীর কাজ করতেন তিনি।

আনন্দ গাঙ্গুলির ছেলে সিন্ধু গাঙ্গুলি বলেন, “বাবা প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলে পূজা করতে যান। আজ সকালেও বেরিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যুর খবর পাই।”

চলতি বছর জানুয়ারিতে এই ঝিনাইদহ সদরেই বালেখাল বাজারে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির আলিকে হত্যা করা হয়।

তিনি 'ধর্মান্তরিত হয়ে' খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে কাজ করছিলেন দাবি করে স্থানীয় চার্চের কয়েকজন সে সময় বলছিলেন, ওই কারণেই 'জঙ্গিরা' তাকে হত্যা করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট সমির হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলেও সে সময় খবর আসে।

গত দুই বছরে এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এসেছে, খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক, ব্লগার, প্রকাশক; ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাবলম্বীরও হামলার শিকার হয়েছেন।

গত তিন দিনের মধ্যে আরও দুটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ করা হচ্ছে অথবা জঙ্গিদের দায় স্বীকারের খবর এসেছে।   

>> রোববার সকালে চট্টগ্রামে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে রাস্তার মধ্যে আক্রান্ত হন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। মোটরসাইকেলে আসা তিনজন প্রথমে কুপিয়ে ও পরে গুলি করে মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। ওই ঘটনার তদন্তে প্রাথমিকভাবে জেএমবি জঙ্গিদের সন্দেহ করছে পুলিশ।        

>> একই দিন সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম  উপজেলার বনপাড়া পৌর এলাকার খ্রিস্টানপাড়ায় নিজের দোকানে খুন হন ৬০ বছর বয়সী সুনীল গোমেজ। তার ভাই প্রশান্ত গোমেজ দিনাজপুরে একটি চার্চের ফাদার; ওই জেলায় সম্প্রতি এক খ্রিস্টান পাদ্রি আক্রান্ত হন। আইএস সুনীল হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের খবর।

গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আরও কিছু ঘটনায় দেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর জড়িত থাকার কথা বলে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে।

গত ১৪ মে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকপাড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মং শৈ উ-কে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনাতেও আইএস এর দায় স্বীকারের খবর এসেছে।

এর আগে গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়ের সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়।

ওই ঘটনাতেও ব্যবহার করা হয় মোটরসাইকেল, অংশ নেয় তিনজন। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানিয়েছে, জেএমবির জঙ্গিরাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। 

২২ মার্চ সকালে কুড়িগ্রাম পৌরসভার গাড়িয়ালপাড়ার ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে তার বাড়ির কাছে গলা কেটে হত্যা করে মোটরসাইকেলে আসা তিনজন।

৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে খুন হন নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার নামের এক দর্জি, যাকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এক মামলায় তিন মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছিল। সেখানেও হত্যাকাণ্ডের ধরণ ছিল একই রকম।

গত বছর ১০ ডিসেম্বর রাতে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ গ্রামে ইসকন মন্দিরে ধর্মসভা চলাকালে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এতে দুইজন আহত হন।

গুলি ও বোমা ছুড়ে পালানোর সময় স্থানীয় জনতা এক যুবককে ধাওয়া দিয়ে আটক করে পুলিশে দেয়। পরে তার স্বীকারোক্তিতে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় বলে পুলিশ জানায়।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর সকালে দিনাজপুর শহরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা ইতালীয় নাগরিক পিয়েরো পারোলারিকে (৭৮) গুলি করে আহত করে।  

পিয়েরো পারোলারি দিনাজপুরের সুইহারি ক্যাথলিক চার্চের ফাদার। পেশায় চিকিৎসক এ ইতালীয় নাগরিক শহরের সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।

গত বছরের ৫ অক্টোবর ধর্মীয় দীক্ষা নেওয়ার কথা বলে তিন যুবক ঈশ্বরদীর পৌর এলাকার স্কুলপাড়ায় লুক সরকারের ভাড়া বাসায় গিয়ে তাকে গলাকেটে হত্যার চেষ্টা চালায়। লুক সরকার পাবনার ঈশ্বরদীর ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গডের যাজক ছিলেন।

এছাড়া চলতি বছর ২১ মে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৫৫ বছর বয়সী বাউলভক্ত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক মীর সানোয়ার হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বাধা দিতে গিয়ে গুরুতর আহত হন সানোয়ারের বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান (৪৫)।

ওই ঘটনাতেও মটরসাইকেলে করে এসেছিল তিন হামলাকারী, পরে এসেছিল আইএসের দায় স্বীকারের খবর।

আর ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগানে খুন হন ইউএসএআইডি কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়। তারা দুজনই সমকামী অধিকারকর্মী ছিলেন।

ওই ঘটনায় আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা- একিউআইএস দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ।  

এ ধরনের ঘটনায় প্রথম একিউআইএসের নামে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার দায় স্বীকারের খবর আসে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি নাকচ করে বরাবরই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাইরের কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘দেশে জন্ম নেওয়া জঙ্গিরা’ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।