‘বন দখলের জন্য’ বারবার আগুন সুন্দরবনে

সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার পেছনে কয়েক একর বিলে অবৈধভাবে মাছ শিকারের ‘কর্তৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টায় থাকা’ স্থানীয় একটি প্রভাবশালী ‘চক্রকে’ দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।

অলীপ ঘটক বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2016, 04:17 AM
Updated : 6 May 2016, 04:17 AM

তারা বলছেন, বন বিভাগ এসব বিষয়ে ‘উদ্যোগী হওয়ায়’ ওই চক্রের সদস্যরা সুন্দরবনের ক্ষতি করছে। প্রভাবশালী ওই চক্রের সদস্যদের ‘বিরোধও’ এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে তাদের ধারণা। 

চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের আওতাধীন বেশ কয়েক একর বনভূমি তুলনামূলকভাবে নিচু। শুষ্ক মৌসুমে ওই বনভূমিতে পানি থাকে না; তবে বর্ষার সময় পানি জমে। সে সময় ওই এলাকায় শিং, মাগুর, কইসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বন বিভাগের অনুমতি না নিয়েই কয়েকশ জেলে প্রতি বর্ষায় ওই এলাকা থেকে লাখ লাখ টাকার মাছ ধরেন। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘হাত করে’ সেই প্রভাবশালী চক্র টাকার বিনিময়ে জেলেদের এভাবে মাছ ধরার সুযোগ দিয়ে আসছিল। 

বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেছেন, তাদের কেউ এতে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ১৪ বছরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জে শুধু ধানসাগর স্টেশনের আওতাধীন এলাকাতেই ২১ বার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৭ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিলের মধ্যে চারবার আগুন লেগেছে বনে।

সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলায় এলাকায় আগুন লাগার পর বনবিভাগ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে বনের সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে।

ফাইল ছবি

আগের কোনো আগুনের ঘটনায় মামলা না হলেও গত ১৩ এপ্রিল, ১৮ এপ্রিল ও ২৭ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডের পর তিনটি মামলা করেছে বনবিভাগ।

ধানসাগর স্টেশনের শেষ অংশ ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা এলাকাটি ভোলা নদী দিয়ে বন থেকে বিচ্ছিন্ন। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বনসংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা হরহামেশা সুন্দরবনে আসা-যাওয়া করছেন। সেখানে গবাদি পশুও চড়াচ্ছেন তারা।

ভোলা নদী পার হয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার বনের ভেতর ঢুকলে দেখা যায় আগুনে পোড়ার ক্ষত। কয়েক একর এলাকায় বনভূমি পুড়ে ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।

রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা কমিটির শরণখোলা রেঞ্জের সভাপতি আসাদুজ্জামান মিলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ধানসাগর স্টেশনের আওতাধীন বনে দশটি নিচু এলাকা (বিল) রয়েছে, যেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।

“রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারিসহ আট থেকে দশজনের একটি প্রভাবশালী চক্র মাছধরার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাত করে তারা জেলেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে মাছ ধরার সুবিধা করে দিত।”

আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে মাছ ধরার সুবিধার জন্য ওই চক্রটি ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করত, কাটা ঝোপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলত। কিন্তু বনবিভাগ এ বছর ‘আগেই সতর্ক হওয়ায়’ এবং কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, “বনবিভাগের ওপর ক্ষুব্দ হয়ে তারা সুন্দরবনের বার বার ক্ষতি করছে।”

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনটি মামলার মধ্যে দুটি হয়েছে বাগেরহাটের বন আদালতে; অন্যটি শরণখোলা থানায়। তিন মামলারই বাদী ছিলেন ধানসাগর স্টেশনের বন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ, যাকে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

ওই তিন মামলার প্রতিটিতেই শাহজাহান শিকারিকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পর থেকে ‘এলাকা ছাড়া’ হওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বার বার আগুনের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদের ভাষ্য, ‘ক্ষমতাসীন দলের’ সেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ‘মামলা করেছিলেন বলেই’ তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে।   

“আমি স্টেশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর সতর্ক ছিলাম। গত ১৩ এপ্রিল আগুন লাগার পর তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করি। এতে ওই চক্রটি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

“নতুন করে যাতে আগুন না দেওয়া হয়, সেজন্য ২৫ এপ্রিল গ্রামবাসী, জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করেছিলাম। সেখানে বনের ক্ষতি হতে দেবে না বলে শপথ নিয়েছিল স্থানীয়রা। কিন্তু মাছ ধরার সুবিধা পাবে না বলে ওই চক্রটি আবারও আগুন দিয়েছে।”

বন বিভাগের তিন মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হলেও শাহজাহান শিকারি ছাড়া বাকিদের নাম  প্রকাশ করা হয়নি। ওই ‘প্রভাবশালী চক্রে’ আর কে কে আছেন, সে প্রশ্নে সুলতান মাহমুদও কারও নাম বলেননি।

তবে বনসংলগ্ন উত্তর রাজাপুর গ্রামের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে রায়েন্দা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন খানের নাম শোনা যায়। ২৭ এপ্রিল সুন্দরবনে আগুন লাগার পর শরণখোলা থানা পুলিশ জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদও করে।

শরণখোলা থানার ওসি মো. শাহ আলম মিয়া বলেন, “বনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জাকির খানকে সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছিল। কিন্ত তার সম্পৃক্ততা না মেলায় পরদিন তাকে ছেড়ে দেই।”

স্থানীয় একাধিক জেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন,  জাকির হোসেন গত কয়েক বছর ধরে ‘শাহজাহান শিকারির সঙ্গে মিলে’ ধানসাগর এলাকা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে আসছিলেন। কিন্তু গত ২২ মার্চ নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে ‘বিরোধ তৈরি হয়’। এরপর সুন্দরবনে আগুনের ঘটনায় জাকির তার সঙ্গীদের নিয়ে আগুন নেভাতে বনবিভাগকে সহযোগিতাও করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাকির হোসেন বলেন, “সুন্দরবনে আগে কীভাবে আগুন লেগেছে তা আমি জানি না। তবে সর্বশেষ তুলাতলা এলাকার আগুন দেখে আমি নিশ্চিত, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেখানে আগুন দেওয়া হয়েছে।”

স্থানীয় এই আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেন, বনে আগুন লাগার ঘটনায় তার কোনো ‘হাত নেই’। তিনি বা তার সঙ্গীরা কেউ মাছ ধরার সঙ্গেও জড়িত নন।

“বরং আমি আমার লোকজন নিয়ে বনবিভাগের সঙ্গে আগুন নিভিয়েছি। স্থানীয় একটি চক্র আমাকে আগুনের ঘটনায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “সুন্দরবনে আগুন দিয়ে যারা ক্ষতি করছে, তারা আমার দলের হলেও ছাড় পাবে না। তাদের ধরে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।”

নাশকতা ঠেকানোর উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, চাঁদপাই রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় বিনা অনুমতিতে সব ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানুষ যাতে বনে ঢুকতে না পারে সে জন্য তিনজন করে পাঁচটি দল গঠন করা হয়েছে।

“ওই কমিটির সদস্যরা পর্যায়ক্রমে সুন্দরবনের ওই অংশে দিন-রাত পাহারা দিচ্ছেন। বন কর্মকর্তাদের টহলও বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি বনসংলগ্ন বাসিন্দাদের সচেতন করা হচ্ছে।”

প্রভাবশালী ওই চক্রের সঙ্গে বনবিভাগের কর্মীদের যোগসাজশের অভিযোগের বিষয়ে ডিএফও সাইদুল ইসলাম বলেন, “বন বিভাগের কোনো স্টাফ যদি কোনো জেলেকে অবৈধভাবে মাছ ধরার সুবিধা দিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই স্টাফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”