নাড়ির টানে সীমান্ত মুখর

স্বজনের দেখা পেতে পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্ত এলাকা হাজারো মানুষের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে।

সাইফুল আলম বাবু পঞ্চগড় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2016, 04:42 PM
Updated : 13 April 2016, 04:42 PM

অমরখানা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান জানান, প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ শুরুর দিন পহেলা বৈশাখে দুই দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা বাংলাভাষী লোকজন বিজিবি-বিএসএফের সম্মতিতে দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ পায়।

“মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও বছরের এ দিনের অপেক্ষায় থাকেন সবাই।

“কিন্তু এবার ভারতে নির্বাচন ও নিরাপত্তাজনিত কারণে কিছুটা অনিশ্চয়তা ছিল। এজন্য পহেলা বৈশাখের একদিন আগেই নিজেদের উদ্যোগে লোকজন সীমান্ত এলাকায় জড়ো হন।”

প্রথমে বিজিবি ও বিএসএফ কোনো সাড়া দিচ্ছিল না উল্লেখ করে তিনি জানান, এক পর্যায়ে দুপুর ১টার পর লোকজন অনুমতির অপেক্ষা না করে কাটাতারের বেড়ার দুপাশে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও দেখা-সাক্ষাৎ করতে শুরু করে।

বিকেল ৩টার কিছু পর বিজিবি ও বিএসএফের তাড়ায় লোকজন বাড়ি ফিরে যান তারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, সীমান্তের ৭৪৪ নম্বর মেইন পিলারের ১ থেকে ৭ নম্বর সাব পিলার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় লোকজন কাটাতারের বেড়ার দুপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এপার-ওপার নাড়ির টানে আসা হাজারো অবাল-বৃদ্ধ-বণিতায় লোকারণ্য।

একপাশ থেকে আরেক পাশে নিজের স্বজনকে খুঁজতে দেখা যায়। কেউ স্বজনদের খুঁজে না পেয়ে নাম ধরে ডাকেন। কেউ পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করছেন ‘ওকে দেখেছে কি না’।

পেয়ে গেলেই একে অপরে আবেগে আপ্লুত হতে দেখা যায়।পরস্পরের মাঝে ফুটছে কথার ফুলঝুরি। দীর্ঘদিন পর স্বজনদের কাছে পেয়ে কেউ বা বাকরুদ্ধ। কেউ আবার অশ্রু সজল।

প্রায় সবাই একে অপরকে দিয়েছেন নানা খাবার ও উপহার সামগ্রী। বাদ যায়নি এ সময়ের মূল্যবান ইলিশ মাছও।

কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে এমন নানা অভূতপূর্ব দৃশ্য সীমান্তের কঠোর পরিবেশকে সামান্য সময়ের জন্য মুখরিত করে রাখে।

এপারে কাটাতারের বেড়া থেকেই মাটিতে হাত ছুঁয়ে শ্বশুর যোগিনী মোহনকে (৬৫) প্রণাম করেন মিনতি রাণী (২৫)।

যোগিনী মোহনের সবচেয়ে ছোট ছেলে হরিশ মোহনের (২৮) স্ত্রী মিনতি বললেন, “বিয়েতে শ্বশুর মশাই আসতে পারেননি। তাই তাকে দূর থেকে প্রণাম করেছি। ”

ভারতের জলপাইগুড়ি শিবমন্দির এলাকায় বসবাসরত ছেলে প্রহল্লাদ ও দীনবন্ধুকে দেখতে এসেছিলেন মা দয়ামনি (৬০)। তিনি থাকেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের আমলাহার কালেশ্বর গ্রামে।

মা-ছেলে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথা বলেন। শেষে সবাই অশ্রুসজল চোখে বিদায় নেন।

দয়ামনি বলেন, “ফোনে কথা হলেও দেখাত হয় না। এক বছর পর ছেলেদের সঙ্গে দেখা হল। ওদের দেখে ও খোঁজ-খবর পেয়ে মনটা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। ওদের আশীর্বাদ করেছি যেন ভগবান ওদের ভালো রাখে।

তেঁতুলিয়ার মুলুক চাঁদগছ গ্রাম থেকে ক্ষিতিষ চন্দ্র রায় (৮১) গত বছর দেখা না পেয়ে এবারও এসেছেন ভারতে থাকা দুই মেয়েকে দেখতে।

শিলিগুড়ির পানির ট্যাংকি চটের হাটে থাকা দুই মেয়ে ক্ষিরমতি ও মিরমতি জানান, তার বাবার বয়স হয়েছে।

‘মনটা খুব কাঁদছিল তাকে একনজর দেখার জন্য। দেখা হয়ে ভালো লাগছে।’

১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগে পঞ্চগড়সহ চারটি উপজেলা থানা হিসেবে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ছিল। বিভক্তির পর সীমান্তবর্তী এ এলাকার অনেকের আত্মীয় স্বজন দুই দেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৭০ দশকেও উভয় দেশের লোকজন প্রায় বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারলেও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় ৮০-র দশক থেকে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

এজন্য প্রায় প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের দিনটিতে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে দুই দেশের লোকজন কাঁটাতারের বেড়ার দুপাশে থেকে স্বজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান।

বিশেষ করে অর্থের অভাবে পাসপোর্ট ও ভিসা করতে অসমর্থ দরিদ্র বাংলাভাষি লোকজন এ দিনটির জন্য মুখিয়ে থাকেন বলে জানান স্থানীয়রা।

পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক ইমাম হোসেন বলেন, “আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেওয়া না হলেও আমরা মানুষের দেখা সাক্ষাতে বাধা দেইনি।”

দুই বাহিনীর সহায়তাতেই অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই লোকজন যে যার মত করে কুশল বিনিময় করে বাড়ি ফিরেছেন বলে জানান তিনি।