সাত খুনের দেড় বছর পর নূর হোসেন কারাগারে

ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার পর চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়েছে নারায়ণগঞ্জের আদালত।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2015, 08:39 AM
Updated : 13 Nov 2015, 07:11 PM

শুক্রবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম সহিদুল ইসলাম সাত খুনসহ ১১ মামলায় নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করে এই আদেশ দেন। 

এসব মামলার সবগুলোতেই অভিযোগপত্র হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। নূর হোসেনের জামিনের জন্যও কোনো আবেদন করেননি কোনো আইনজীবী।

আদালতের আদেশের পর তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয় বলে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি নূর হোসেনকে শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে যখন মাসদাইর পুলিশ লাইনস থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আদালতে নিয়ে আসা হয়, সে সময় তার ফাঁসির দাবিতে বাইরে বিক্ষোভ করছিলেন কয়েকশ মানুষ।  

গত বছর মে মাসে সাত খুনের ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম, নজরুলের ভাই আব্দুল সালাম ও নিহত লিটনের বাবা হায়দার আলীসহ অনেকেই এ সময় আদালত চত্বরে উপস্থিত ছিলেন।

তাদের প্রত্যাশা ছিল, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নূর হোসেনের মুখ থেকেই সাত খুনের পেছনের ‘আসল ঘটনা’ উদঘাটন করা হোক। তা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

নূর হোসেনকে আদালতে আনার আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন কয়েকশ সংবাদকর্মী। আদালতে কাঠগড়ায় তোলার সঙ্গে সঙ্গে নূর হোসেন তার মাথা থেকে র‌্যাবের হেলমেট খুলে ফেলেন। তবে তখনও তার গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ছিল।

এ সময় নূর হোসেনকে দেখা যায় অনেকটাই স্বাভাবিক। উপস্থিত বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে তিনি হাসি-ঠাট্টাও করেন। 

আদালতে তোলার নয় মিনিটের মধ্যে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এবং এরপর সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে নূর হোসেনকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

গত ৩০ এপ্রিল লাশ উদ্ধারের ছবি

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়।

নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় অভিযোগ করেন, র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডোর কাউন্সিলর নূর হোসেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরে র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তার সত্যতা পাওয়া যায়। 

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন এবং র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন নূর হোসেন। এক পর্যায়ে নিরুদ্দেশ হন সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই নেতা।

এরপর ২০১৪ সালের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় আদালতে পাসপোর্ট আইনে মামলাও হয়।

শেষ পর্যন্ত দুই সরকারের মতৈক্যে ভারত গত অক্টোবরে ওই মামলা তুলে নেয় এবং আদালত নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি দেয়।

উত্তরা র‌্যাব কার্যালয়ে নূর হোসেন। টিভি থেকে নেওয়া ছবি

বাংলাদেশ উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেওয়ার এক দিনের মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দরে তাকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এরপর র‌্যাব হেফাজতে তাকে শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার উত্তরায়, র‌্যাব সদরদপ্তরে। 

সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর নূর হোসেনকে সাত খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যাব। এরপর সকাল সোয়া ৮টার দিকে পুলিশ তাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসে পৌঁছায়।

নূর হোসেনকে তার নিজের এলাকায় ফিরিয়ে আনার আগেই শহরজুড়ে নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা। সকাল ১০টার দিকে আদালতে তোলার পরিকল্পনার কথা প্রথমে বলা হলেও কোনো মামলায় নূর হোসেনকে রিমান্ডে নেওয়ার সুযোগ আছে কি না- তা খতিয়ে দেখতে দুপুর পর্যন্ত সময় নেন পুলিশ কর্মকর্তারা।  

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন জানান, সাতখুন ছাড়াও চাঁদাবাজি, নদী দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন থানায় নূর হোসেনের ‍বিরুদ্ধে ২২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও ছিল।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এক মামলায় গতবছর নূর হোসেনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওই রায়ের সময় তিনি ছিলেন ভারতের কারাগারে। 

এদিকে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি আদালত প্রাঙ্গণে অভিযোগ করেছেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গেই তার সহযোগীরাও এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে।

“তারা সংঘবদ্ধ হয়ে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আমাদের লোকজনদেরকে মারধর করছে। আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”

নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনায় প্রধামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বামীর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর হওয়া বিউটি বলেন, “অভিযোগপত্র দাখিলের আগে নূর হোসেনকে আনলে ভালো হতো। নূর হোসেন কলকাতায় থাকতে বলেছিল, তাকে দেশে ফেরত নেয়া হলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মুখ খুলবেন। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অসম্পন্ন একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।”

ওই অভিযোগপত্র নিয়ে বিউটি আপত্তি জানালেও নারায়ণগঞ্জের জজ আদালতে তা নাকচ হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যাবেন বলেও ইতোমধ্যে জানিয়েছেন তিনি। 

“আমরা চাই  নূর হোসেনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কারা জড়িত? কারা পরিকল্পনাকারী, কারা অর্থের যোগানদাতা? র‌্যাব কেন আমার স্বামীসহ সাত জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করবে? তাদের সাথে তো র‌্যাবের কোনো বিরোধ ছিল না।”

পুলিশ এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিউটি।

নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের বাবা আব্দুল ওহাবও এ মামলার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমার ছেলেকে ফিরে পাব না। কিন্তু আমি ইব্রাহিমসহ সাত জনকে খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি চাই, যারা খুন করেছে আমার ছেলেকে, নূর হোসেন তাদের নাম বলে দিক।”

অভিযোগপত্র হয়ে গেলেও রাষ্ট্রপক্ষ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে নূর হোসেনকে এখনও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন।

সাত খুনের মামলায় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২২ জন কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছেন র‌্যাবের ৮ সদস্যসহ ১৩ আসামি।