জাপানে ভাষা ভোগান্তি!

বিদেশে উচ্চশিক্ষা অথবা কাজের জন্য যাওয়ার পর প্রথম যে সমস্যাটিতে পড়তে হয় তা সম্ভবত ভাষা।

মোঃ সাইফুল ইসলাম, জাপানের তয়ামা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2015, 11:44 AM
Updated : 7 Jan 2016, 09:29 AM

ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে একটু কম হলেও অন্যান্য দেশগুলোতে এই সমস্যা বেশ প্রকট হতে পারে। আর সেই দেশ যদি হয় জাপান তাহলে আর কথাই নেই। জাপানের প্রধান দুই-একটি শহর ছাড়া ইংরেজিতে কথা বলার লোকের সংখ্যাটা হাতেগোনা, সেটা অফিস হোক আর বিশ্ববিদ্যালয় হোক।

 জাপানে আসার আগে দুটি বাক্য আর হাতেগোনা কয়েকটি শব্দ শিখে এসেছিলাম। বাক্য দুটি হল, ‘ওয়াতাশি ওয়া সাইফুল দেস’ এবং ‘বাংগুরাদেশ কারা কিমাসতা’, যার অর্থ আমার নাম সাইফুল এবং আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। গুটিকয়েক শব্দ যেমন সুমিমাসেন (এক্সকিউজ মি), আরিগাতো গোজাইমাস (আপনাকে ধন্যবাদ), কন্নিচিওয়া (হ্যালো) ছিল চলার পথের সম্বল।

মনেমনে মাঝে মাঝেই ভাবতাম ইস, কেন যে এই দেশে এলাম! সারাজীবন ইংরেজি শিখলাম আর তা কোথাও কাজেই আসছেনা! যাই হোক, মুখস্ত সেইসব শব্দ নিয়েই শুরু হল পথচলা। যেখানেই যাই সেখানে এই জানা শব্দগুলোই ব্যবহার করি!  আমার কাছে হয়তো জানতে চাইলো নাম কি, আমি উত্তর দিলাম আরিগাতো গোজাইমাস (ধন্যবাদ আপনাকে) অথবা কেমন আছি এর উত্তরে সুমিমাসেন (এক্সকিউজ মি)!

সমস্যা প্রকট হল যখন দেখলাম গবেষণায় আমার সহকর্মীরাও ইংরেজিতে বিশেষ দুর্বল এবং এই ভাষা বলতে ততোধিক লজ্জা অনুভব করেন। উপায় না দেখে প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করবো? তিনি জাপানি ভাষা শেখার কোর্সে ভর্তি হয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রটি যে আমি তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা!

অন্য সবাই কমবেশি শিখে এসেছে দেশ থেকে, আর আমি শুধু দুই তিনটা শব্দের সম্বল নিয়ে এসেছি। ক্লাসে যাই আর সবার সামনে লজ্জায় পড়ি! কিছুদিন পরে শিক্ষকরাও বুঝে গেলেন যে আমাকে দিয়ে হবে না, তখন আমার জন্য আলাদা ক্লাসের ব্যাবস্থা হল। আর ধৈর্যের দিক থেকে জাপানি শিক্ষকদের তুলনা নেই বলা যায়।

দেখতে দেখতে পাঁচ মাস পর আমি অনেককে অবাক করে দিয়ে চলাফেরা করার মত জাপানি ভাষা ব্যবহার করতে শিখে গেলাম! আমার সহপাঠী এবং শিক্ষকরা খুবই অবাক।

এরপর শুরু হল আসল চর্চা। যাকে পাই তার সঙ্গেই কথা বলি, ভুল শুদ্ধ বিচারের সময় কোথায়? তবে সবাই যখন জানতে পারে পাঁচ-ছয় মাস আগে এসেছি জাপানে, তখন বলে ‘নিহঙ্গ সুগই দেস নে’(তোমার জাপানি অসাধারণ)। আমিতো খুশিতে আটখানা! আর বলি, আরে না একটু-আধটু পারি! এভাবে ধীরে ধীরে ভাষা রপ্ত করার সময় এর প্রতি এক ধরনের ভালোলাগা জন্ম নিল।

আর জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারার কারণে অনেক জাপানি বন্ধু হল, সহ-গবেষণাকর্মীরাও বেশ খুশী। অনেক কিছু জানতে চায় আমাদের সম্পর্কে, দেশ সম্পর্কে। আমারও উত্তর দিতে পেরে ভালই লাগে।

তবে ভাষা ভালভাবে ব্যবহার করতে পারার আগের দুইি-একটি কথা না বললেই না।  

জাপানে পৌঁছবার কয়েকদিন পরে দেখলাম রাস্তায় পুলিশ বাইসাইকেল চেক করছে আর আমি বাসার দিকে যাচ্ছি। বলে নেওয়া দরকার এদেশ সকল বাইসাইকেল রেজিস্টার্ড এবং পুলিশের কাছে অনলাইন ডেটাবেজ থাকে। সাইকেলের গায়ে লাগানো নাম্বার দেখে মিলিয়ে নেয়া তাদের কাজ। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “কোরে ওয়া দারেনো জিতেনশা দেসকা?” অর্থাৎ এটা কার বাইসাইকেল? আমি না বুঝেই বললাম, আমার নাম সাইফুল, আবার একই প্রশ্ন এবং আমার উত্তর আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তৃতীয়বারের উত্তরে আমি বললাম আরিগাতো গোজাইমাস (ধন্যবাদ)। পুলিশ অফিসার এবার হেসে দিয়ে বলল অপেক্ষা করো তোমার সাইকেল নাম্বার দেখি। দেখার পরে নাম্বার মিলিয়ে ছেড়ে দিলো!

একদিন বাজার করার জন্য গেলাম একটি সুপার শপে। জানতে চাইলাম হালাল খাবার আছে কিনা। আমাকে কিছু একটা বলে চলে গেল সেই বিক্রয়কর্মী। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমার দিকেই আসছে। ভয় পেয়ে গেলাম। একেতো এইদেশে নতুন, তারপর আবার জানিনা ভাষা। কি যে হবে কে জানে? তারা অনেকভাবে প্রশ্ন করে জানতে চাইল, আমি আসলে কী জানতে চাই। বুঝতে না পেরে প্রথমজন বাকি সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে। সবাই মিলেও আমার কাছ থেকে কিছু বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে তাদের বস এসে হাজির, সে ও বুঝলনা আমার কথা। পরে ইন্টারনেটে খুঁজে নিশ্চিত হলাম যে শব্দটার জাপানি উচ্চারণটা হবে “হারারু”। জাপানি ভাষায় “এল” উচ্চারণই নেই!

দেখতে দেখতে জাপানে দেড় বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেললাম এখানে। জাপানি ভাষা বলতে পারলেও লিখতে ও পড়তে পারাটা আজও হয়ে ওঠেনি। অদূর ভবিষ্যতে হয়তবা সেটাও হতে পারে। দিনে দিনে ভাষাটার প্রতি এক ধরনের মমতা যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু দিন শেষে আমার বাংলার মত কিছুই হয়না! ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা এখন থেকে সরাসরি আমাদেরকে জানাতে পারেন। পুরো নাম, ঠিকানা ও ছবিসহ লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়  probash@bdnews24.com