ফুজি পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে

জাপানের ফুজি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে সূর্যোদয় দেখার কথা আমাদের। এ বছরের অগাস্টের সাতাশ তারিখের ভোর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

পি.আর. প্ল্যাসিড, জাপানের টোকিও থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2017, 06:07 AM
Updated : 23 Sept 2017, 07:01 AM

পরিকল্পনা অনুযায়ী বাসা থেকে বের হলাম জাপানি ভাষা শিক্ষা কোর্সের ছাত্র রহমত উল্লাহ আর মো.শাহীন আলীকে নিয়ে। মাঝ পথে কানাগাওয়া প্রিফেকচারে বান্দা রেল স্টেশনে গিয়ে আমরা সহিদুল হকের গাড়িতে চড়বো। বান্দা স্টেশন পৌঁছে সময় মতো সহিদুলকে পেলাম ঠিকই, কিন্তু সেখান থেকে আর ফুজি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেননি।

আমাদের কাছে তিনি তার পূর্ব পরিকল্পনার কথা গোপন করেন। নিয়ে গেলেন কানাগাওয়া ফায়ার ওয়ার্কস দেখাতে। আমাদেরকে সেখানে রেখে তিনি তার গোপন কাজে চলে যান। ফিরে আসেন রাত ১টার সময়। মেজাজ তখন আমাদের কারোই স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। সহিদুলের সাথে হালকা রাগ দেখালেও পাহাড়ের চূড়ায় যেতে আমাদের কিছুটা যে ধৈর্য্ ধরতে হবেই। তাই ভেতরে রাগ চেপে রেখে গাড়িতে বসলাম।

কিছুদূর যেতেই সবার ক্ষুধা লেগে গেলো। সহিদুল তার গাড়ির কথা চিন্তা করে পেট্রোল পাম্পে আগে যাবেন বললেন। তখন মধ্যরাত। রাস্তা ফাঁকা। একসময় হাতের ডান দিকে বেঁকে গাড়ি ঢুকলো এক কনভিনিয়েন্স স্টোরে। ঢুকতেই দেখি অল্প বয়সী এক মেয়ে একটা ফিফটি সিসি ভেসপার উপর বসে বুকের কাপড় খুলে রেখে গায়ে বাতাস লাগাচ্ছে আর সিগারেট ফুঁকছে। সহিদুল আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে অপরাধীর মত নিজেই বেরিয়ে গেল খাবার কিনতে।

মেয়েটিকে একা বসে থাকতে দেখে জানালার গ্লাস নামিয়ে কিছুটা মাথা বের করে বললাম, আমরা ফুজি পাহাড়ে যাচ্ছি, সময় থাকলে সাথে যেতে। মেয়েটি হেসে জানালো যে ওর আরও বন্ধু আছে সাথে। ওদের রেখে সে একা যেতে পারবে না। ওর সাথে কথা বলতে বলতে সহিদুল ফিরে এলেন ব্যাগ ভর্তি খাবার নিয়ে।

আমরা রওনা দিলাম। সহিদুল জানালো, গন্তব্যে যেতে দুই ঘণ্টা লাগবে। আমরা চুপচাপ খেয়ে নিলাম। তারপর গাড়িতেই ঘুমিয়ে গেলাম। পাহাড় বেয়ে গাড়ি উপরে উঠছিলো। ঘুম ভাঙ্গলে সহিদুল বললেন, এখান থেকে ফুজি পাহাড়ের শুরু। আমরা উপরে উঠছি।

না বললেও কান ব্যাথার কারণেই বুঝতে পারছিলাম যে আমরা উপরে উঠছি। কোথাও কোথাও কুয়াশায় পথ ঢেকে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ডানে-বামে বন। হঠাৎ ভুতুরে আওয়াজ ভেসে এলো কানে। আমি ভয় পেলাম। জানতে চাইলাম কিসের আওয়াজ এটা। আমার প্রশ্ন শেষ করার আগেই সহিদুল বললেন, ভূতের শব্দ। সাথে সাথে আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো ভয়ে!

কিছুদূর যেতেই আমাদের গাড়ি থামানো হলো। এত রাতেও সেখানে টহলে লোক ছিলো। আমাদের বলা হলো, গাড়ি নিয়ে উপরে ওঠা যাবে না, সকালে ট্যুরিস্ট বাসে আসতে হবে। কোথা থেকে বাস ছাড়া হয় সেটাও বলে দিলো। আমরা ফিরে গেলাম ওদের বলা নির্ধারিত স্থানে।

ফিরে যাবার সময় সহিদুল বললেন, রাস্তার ধারে হরিণ থাকতে পারে। বলতে না বলতেই চোখে পড়লো কয়েকটা হরিণ, গাছের আবডালে দাঁড়িয়ে আছে।

গাড়ি পার্ক করে গেলাম তথ্যকেন্দ্রে। সেখানে নোটিশ বোর্ডে সব লেখা আছে। ভোর সাড়ে ৫টার সময় ট্যুরিস্ট বাস এখান থেকে ছাড়া হয়। পাশেই ওয়াশ রুম। আমরা ফ্রেশ হয়ে গাড়িতে গিয়ে ঘুমালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই রহমত আর শাহীন গেলো বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে বিশাল বড় লাইন। শাহীনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রহমত চলে এলো আমাদের আর পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম নিতে। সহিদুল বললো, সে যাবে না। গাড়িতে বসে সারাদিন ঘুমাবে।

বাকিদের নিয়ে রওনা দিলাম। ১৮৯০ ইয়েন করে তিনজনের টিকিট কেটে আমরা চড়ে বসলাম বাসে। ঠিক চল্লিশ মিনিট পর ফুজি পাহাড়ের স্টেজ ফাইফ (৫ ধাপ) পর্যন্ত গিয়ে বাস আমাদের নামিয়ে দিলো। বাস যখন উপরে উঠছিলো, তখন প্লেন আকাশে মেঘের উপর দিয়ে উড়ার সময়কার মতো কানে চাপ সৃষ্টি হয়ে ব্যাথা শুরু হলো। কান ধরে বসার ইচ্ছেটাকে দমন করলাম, যখন দেখি অন্য কেউই কানে আঙ্গুল দিয়ে বসেনি।

এখানেও খেয়াল করলাম, কুয়াশা পাহাড়ি পথকে অন্ধকার করে রেখেছে। কোথাও কোথাও পরিষ্কার, আবার কোথাও কোথাও সাদা কুয়াশা। চালক জাপানিজ ভাষায় বলছিলেন, কিরির কারণে দূরে রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। পরে আবিষ্কার করলাম, কিরি হলেও এসব মেঘ। আকাশে আমরা যে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখি, সেই মেঘ। জাপানিজ শব্দ ‘কিরি’ অর্থ ‘কুয়াশা’ হলেও এই মেঘকেও ওরা কুয়াশাই বলছে।

ভেসে আসা মেঘের কারণে এতোটাই শীত করছিল যে দু’হাত পকেটের বাইরে রাখতে পারছিলাম না। তখনও সেখানে কোনো দোকানপাট পুরোদমে খোলেনি। স্টেজ ফাইভে রয়েছে খাবার দোকান, মার্কেটসহ ট্যুরিস্ট স্পট। শাহীন কিছু বিস্কুট কিনে নিলো।

হাতে লম্বা লাঠি আর গায়ের কাপড় পরে রওনা দিলাম আমরা। লাঠি হাতে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। যেখানে এসে আমরা বাস থেকে নেমেছি, সেখান থেকে নিচে তাকালে পুরো জাপান যেন চোখে পড়ে। সমতল ভূমি থেকে ২ হাজার ৩০৫ মিটার উঁচুতে আমরা অবস্থান করছিলাম তখন। কয়েক মিনিট হাঁটার পরেই দেখি, মেঘ আমাদের নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেখান থেকে হেঁটে ৬ ধাপ পর্যন্ত খুব সহজেই যেতে পারলাম। যাবার পর যখন ধাপ সাতের দিকে রওনা দিলাম, তখন আমার পা আর চলছিলো না। ক্রমেই ক্ষুধা বাড়ছিলো। এতোটাই খাড়া পথ যে ইচ্ছা করলেই দৌড়ে উপরে ওঠা যায় না। পুরোটা পথ ছোট-বড় পাথরে ভরা। আমি যেহেতু ওপরে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি, তাই লাঠিও নিয়ে আসিনি। শাহীন আর রহমত উল্লাহ নিয়ে এসেছিলো। শাহীনের লাঠি আমার হাতে। আমি এক হাতে সেই লাঠি নিয়ে মাটিতে ভর করছি, আরেক হাতে শাহীনকে ধরেছি। শাহীন আমাকে টেনে তোলার মতো করে হাঁটছিল।

একটু পরপর আমি মাটিতে বসে পড়ি নয়তো শুয়ে পড়ি। ওদের সাথে ফুজি পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়া সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছিলো। বাসা থেকে আগের দিন সকালে বের হবার সময় থাইও (আমার ছেলে) আমাকে বারবার বলেছে, আমি যেন উপরে ওঠার চেষ্টা না করি। মাঝ পথে কিছু একটা ঘটে গেলে শেষে হেলিকপ্টারের সহযোগিতা নিতে হবে। তখন পুরো খরচটাও যে গুণতে হবে আমাদেরকেই।

একসময় রহমতউল্লা আমাকে আর শাহীনকে ফেলে রেখেই সামনের দিকে চলে গেলো। শাহীনকেও আমি ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম একাই। ক্ষুধার যন্ত্রণায় তখন কাতরাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে এক বুড়ো মহিলার মায়া হলো। কাছে এসে জানতে চাইলো, আমার শরীর খারাপ কিনা। কথা বলার মাঝখানে আমাকে উনি কুকিজ দিলো। সেটা খেলাম। উনিও সাত ধাপ পর্যন্ত গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নেমে যাবেন।

সেখানে বসে বসে কিছু সময় ভাবলাম, এতোটা উপরে এসে আমি কি ফিরে যাবো, নাকি চূড়া পর্যন্ত যাবো? অনেক চেষ্টা করে গেলাম সাত ধাপ পর্যন্ত। তারপর আট  ধাপে। সেখানে এক ঘণ্টা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে লম্বা শ্বাস নিচ্ছিলাম। আমাকে দেখে আবার ক’জন জাপানি বয়স্ক লোক জানতে চাইলেন, আমি কি অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে আছি, নাকি শখ করে? আমি বললাম, “আমি ডায়াবেটিক রোগী, সম্ভবত ব্লাড সুগার বেড়ে গেছে।” বলার সাথে সাথে ওরা আমার সুগার মেপে দেখলো যে তা সাংঘাতিক রকম বেড়ে আছে। অবস্থা দেখে এবার আমাকে নেমে যেতে পরামর্শ দিলেন।

ফুজি পাহাড়ের চূড়ায় যারা যাচ্ছেন, তাদের ফিরে আসার পথ ভিন্ন। যে পথ দিয়ে উপরে উঠছ্‌ সেই পথেই যদি কেউ নিচে নামতে থাকে, বুঝতে হবে সে আর পারছে না। এরা সংখ্যায় খুব কম। আমি তাদের দলে নাম লেখালাম। শুরু করলাম উপর থেকে নিচের দিকে নামতে। এবার বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। ধাপ ছয় পর্যন্ত নেমে কিছুসময় সেখানে বিশ্রাম নিলাম।

থেকে থেকে এই উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে ঘোড়া আসা-যাওয়া করছিল। দেখে মনে হচ্ছে, ঘোড়ার পিছে বসা এরা সবাই অসুস্থ। ধাপ পাঁচ পর্যন্ত নেমে চাইনিজ খাবারের এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে পেট পূজা দিলাম। এরপর সেখান থেকে ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে আবার চলে গেলাম একদম নিচে, গাড়ি যেখানে পার্ক করা আছে সেখানে। সেখানে গিয়ে দেখি গাড়িও নেই, সহিদুলও নেই। আমার তখন খুব যন্ত্রণা হচ্ছিলো!

কাছেই ছিল সবুজ ঘাস। সেখানে বসে যখন যেটা খেতে মন চাইলো, সেটা কিনে খেয়ে ঘাসের উপর শুয়ে দিলাম ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যা ৭টার সময়। ৯টা পর্যন্ত সেখানে ঘোরাঘুরি করে সহিদুল ও অন্য দুইজনের অপেক্ষা করছিলাম বাস স্ট্যান্ডের পাশে।

ঠিক রাত ৯টার কিছু সময় আগে দেখি সহিদুল ট্যুরিস্ট বাস থেকে নামছে। রাগে তখন শরীর আমার কাঁপছিলো। নিজে থেকেই বললেন, ধাপ পাঁচ পর্যন্ত গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গী দুইজনের খোঁজে। তারা নাকি পথ হারিয়ে চলে গেছেন অন্য জেলায়।

মূলত ফুজি পাহাড় তিনটি জেলার উপর দাঁড়িয়ে আছে। উপরে ওঠার পর সেখান থেকে নামার পথও নাকি ভিন্ন জেলার জন্য আলাদা রয়েছে। তারা ভুল করে অন্য জেলার পথ ধরে নেমে যাওয়াতে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যই নাকি সহিদুল গিয়েছিলেন ধাপ পাঁচ পর্যন্ত। কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টায় ফিরে আসলেন। তার মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ করলাম শাহীন আর রহমত উল্লাহর সাথে। ওরা যেখানে আছে, আমাদের সেখানে যেতে যে সময় লাগবে, সেই সময়ে তারা টোকিও চলে যেতে পারবে। তাই তাদেরকে ট্রেনে বা বাসে করে টোকিও চলে যাবার পরামর্শ দিয়ে আমরা রওনা দিলাম নিজেদের ঠিকানার দিকে।

টোকিও থেকে এর অবস্থান ৬০ মাইল (১০০ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হনশু দ্বীপে। উচ্চতা প্রায় ১২ হাজার ৩৮৯ ফুট। এটি একটি লাভা গঠিত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ১৭০৭-০৮ সালে এখানে সর্বশেষ অগ্নুৎপাত ঘটে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে টোকিও থেকেই এই পর্বতের চূড়ার দৃশ্য দেখা যায়।

২০০৩ সালের ২২ জুন এই ফুজি পাহাড়কে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতি বছর এখানে তিন লক্ষাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে, যার মধ্যে অধিকাংশই বিদেশি পর্যটক। জাপানের ইয়ামানাসি ও শিজোওকা প্রিফেকচারের উপর এই ফুজি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। এর উপরে উঠতে চারটি পথ আছে।

জাপানে যেসব বাংলাদেশিরা আছেন, তাদের একবার অন্তত এখানে এসে চূড়ায় চড়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া দরকার।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!