সামনে এগিয়ে ইনফরমেশন ডেস্কে বোর্ডিং পাস দেখিয়ে ডিপারচার লাউঞ্জটা কোনদিকে জানতে চাইলাম। হেজাব পরা মধ্যবয়সী একজন নারী বোর্ডিং পাসে চোখ বুলিয়ে আমার নাম ও ফ্লাইট নম্বর মিলিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক নজর দেখে আমাকে কিভাবে যেতে হবে তা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলো।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বোর্ডিং পাস ফেরত নিয়ে হাতের ব্যাগ উঠিয়ে ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে রওনা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পেছন থেকে নারী কণ্ঠের ‘এক্সকিউজ মি’ শুনতে পেলাম।
দ্বিধান্বিতভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ইনফরমেশন ডেস্কের সেই নারীকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। আমি থেমে আমার বোর্ডিং পাস আর হাত ব্যাগ পরীক্ষা করে নিলাম। নাহ, কিছুই তো ফেলে আসিনি। তবে কী ওই নারী আমাকে ভুল গেইটের ঠিকানা দিয়েছে?
আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি, তাহলে তুমি নাইম, তাই না?
আমি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললাম- এক্সকিউজ মি! হ্যাঁ, কোনও সমস্যা?
তিনি আবারও মিষ্টি হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বললেন- হ্যাঁ, সমস্যা তো একটা আছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি সব বিস্ময়কে হার মানিয়ে বলল- আমি আইনি, নুরুল আইন। এখন চিনতে পেরেছো?
আমি বিস্ময়ের ধাক্কা সামলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য অতীতের স্মৃতিতে ফিরে গেলাম।
যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন আমার ফুফাতো ভাই শিবলি একদিন আমাকে বলল, পেন ফ্রেন্ডশিপ করবেন? আমি সরাসরি বললাম, না।
শিবলি আমাকে বুঝিয়ে বললো, ওর একজন ভালো পেন ফ্রেন্ড আছে। ওর বোন কারও সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়। ব্যাপারটা খারাপ কিছু না। তাছাড়া ফ্রেন্ডশিপে ইংরেজি লেখাটেখারও ভালো চর্চা হয়।
আমি রাজী হয়ে গেলাম। আমার পেন ফ্রেন্ড নুরুল আইন সিঙ্গাপুরে থাকে। কয়েকটি চিঠি চালাচালির পর আমাদের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি হল।
১৯৮৭ সালে আমি, মরহুম খসরু ভাই তার স্ত্রী রিনা ও মেয়ে নওমি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গেলাম। তখন আমরা সবাই আইনিদের ও তার বোন নিসাদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওদের বাবা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তাছাড়াও একবেলা সময় নিয়ে আইনি আমাকে সিঙ্গাপুর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল।
আইনি আমার হাতের ট্রলি ব্যাগটা তার হাতে নিয়ে বলল, তোমার হাতে তো কিছুটা সময় আছে, তাইনা? আপত্তি না থাকলে চল সামনের ওই কফি শপটায় গিয়ে বসি?
আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ওকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরন করে কফি শপে গিয়ে বসলাম। আইনি আমাদের জন্য স্নাক্সস ও কফির অর্ডার দিলো।
আমরা যখন আগে বেড়াতে এসেছিলাম তখনও ওরা দু’বোন এয়ারপোর্টে চাকুরি করতো। আইনি কথায় কথায় ওর বর এবং দুই ছেলেমেয়ের কথা জানালো। আমিও স্ত্রী ও ছেলের কথা বললাম। ফোন থেকে ছবি বের করে দু’ পরিবারের সাথে পরিচিত হলাম। আরও অনেক গল্প হলো।
আইনির ব্রেকের সময় শেষ হয়ে এলো আর আমারও বোর্ডিং এর তাড়া ছিল। আমরা উঠে পড়লাম। আইনি আমাকে লাউঞ্জ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো।
আমাকে বলল- নাইম তোমাকে যদি বিদায়ের আগে একটা প্রশ্ন করি তাহলে তুমি কি কিছু মনে করবে?
আমি মাথা নিচু করে ‘না’ সূচক মাথা ঝাঁকালাম।
তারপরও সে অভয় দিয়ে বললো- আচ্ছা যাও, তোমাকে এখনই উত্তর দিতে হবে না। প্রশ্নটা করেই আমি চলে যাবো। যদি ভবিষ্যতে কখনো দেখা হয় তাহলে উত্তরটা দিলেই চলবে।
ওইবার সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর তুমি আমার আর কোন চিঠির উত্তর দাওনি কেন?
আইনি প্রশ্নটা করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার হাতে ট্রলি ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে রওনা হলো। ঠিক তখনই সময় যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে আমাকেও থমকে দিলো।
সময় আবার চলা শুরু করলে আমি আইনির চলে যাওয়ার শেষ বিন্দু মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে গেলাম।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |