বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

দু’ভাবেই প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দেশে যখন ছিলাম তখন একরকম; আবার এখন ‘প্রবাসী’ তকমা গায়ে মেখে দূরের দেশ থেকে দেখা।

শামীম আল আমিন, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2017, 09:23 AM
Updated : 21 Sept 2017, 09:23 AM

যদিও কেউ কেউ বলেন, ‘আরে ভাই প্রবাসী না ভেবে নিজেকে বিশ্ববাসী ভাবুন না’। তা না হয় ভাবলাম। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় গেলে আজকাল আমাকে ‘প্রবাসী লেখক’ কিংবা ‘প্রবাসী সাংবাদিক’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দেশে থাকলে দেশের ভালো দিকগুলো যেন চোখে পড়তেই চায় না। সারাক্ষণ কেবল অভিযোগ। তার কারণ হিসেবে বলা চলে, প্রিয় মানুষ সবসময় কাছে ঘুর ঘুর করলে, একঘেঁয়ে হয়ে যায় হয়তো।

তার উপর সত্যি তো দেশজুড়ে নানা সমস্যা আর অনিয়ম। বেশিরভাগ মানুষকেই একপেশে জীবনযাপন করতে হয়। ফলে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত মানুষগুলোর অনুযোগের অন্ত থাকে না। সুযোগ পেলেই চোখমুখ খিঁচিয়ে তাই কেবল গালাগাল।

কিন্তু তাই বলে দেশের প্রতি কি ভালোবাসা নেই? কমে যাচ্ছে দিন দিন? মোটেও তা নয়। বুকে ধারণ করে রাখা দেশের প্রতি যে ভালোবাসা ও আস্থা, তা অবিচল। শত দুর্যোগ আর বিপত্তিতেও মানুষ সেখান থেকে সরে না। ক্রিকেট খেলায় প্রিয় কোহলি কিংবা গেইল প্রতিপক্ষ হলেও, আমরা সাকিবকেই মাথায় তুলে রাখি। দেশের সাফল্যে আনন্দে উদ্বেলিত হই। ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলি। আবার ব্যর্থতায় চোখের জলে বুক ভাসাই। অভিযুক্ত করি।

আবার দেখুন না, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা, বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে মানুষের কি ঢল! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনার ওঠে ফুলে ফুলে সেজে। পহেলা বৈশাখে মানুষের সেকি রঙ রূপ। ফেব্রুয়ারির বইমেলায় নতুন বইয়ের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ।

যদিও এমন চিত্রের বাইরে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর উপস্থিতিও রয়েছে। এরপর দেশের প্রতি ভালোবাসা ধারণ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এ জাতির তুলনা হয় না।     

এবার আসি প্রবাস থেকে দেখা বাংলাদেশের কথায়। অনেক কিছুই আমার কাছে নতুন মনে হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের মানুষগুলোকে নতুন করে দেখছি, চিনছি। চেনা-অচেনা ভূবনে, আমি এখনো ‘আগন্তুক’। তবে দূরে চলে এলে ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিতে বোধহয় নানা পরিবর্তন চলে আসে। সেই ভালোবাসা হয়ে ওঠে তীব্র; প্রকাশের ভঙ্গিও তার চেয়ে কম নয়। ফলে বাংলাদেশের যেকোন ধরণের ভালোমন্দ খবরে প্রবাসীদের মধ্যে দিনরাত আলোচনা চলতেই থাকে।

ভৌগলিকভাবে তারা থাকেন অনেক দূরে, অন্য একটি দেশের মাটিতে। অন্য সংস্কৃতিতে। কিন্তু ধারণ করে থাকেন রেখে আসা নিজ দেশকে। দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস তারা ঘটা করে পালন করেন।

নিউ ইয়র্কের কথা বলতে পারি, বাংলাদেশের যেকোনো উৎসবে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ আর উপস্থিতি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো পহেলা বৈশাখ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালন করা হয়।

অনন্য আয়োজনে নিজেদের মতো করে স্বাধীনতা দিবসের প্যারেড হয়। বৈশাখি মঙ্গল শোভাযাত্রা চলে যায় নিউ ইয়র্কের রাজপথ দিয়ে। করা হয় বইমেলার আয়োজন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা থাকে পরম মমতায়। তাতে নানান দেশের মানুষও অংশ নেন। এই সুযোগে বিদেশিরা বাংলাদেশকে বোঝার সুযোগ পায়। যদিও বিষয়গুলো কতটা যথাযথভাবে তুলে ধরা যাচ্ছে, তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

নিউ ইয়র্কে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বসবাস করে। তাদের অনেককেই দেখেছি, নিজেদের কোনও জাতীয় দিবসে ঐক্যবদ্ধ বিশাল আয়োজনে, চমৎকার প্রস্তুতিতে বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরতে। তাতে অধিক সংখ্যক মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।

আমাদের আয়োজনে প্রায় সবক্ষেত্রেই ‘ঐক্য’ অনুপস্থিত। দলাদলিতে বড় কোনও উদ্যোগ নেই। কেউ কোনও উদ্যোগ নেয়ার পর, কিছুদিনের মধ্যে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে কেন্দ্রীয় আয়োজনের বদলে, সেই জায়গায় আমরা দেখছি ক্ষুদ্র কোনও গোষ্ঠির দুর্বল উদ্যোগ। যা যথাযথভাবে বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে তুলে ধরছে না। অনেক ক্ষেত্রে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে।

যদিও এরমধ্যেও অনেক আয়োজন মানে ও প্রচেষ্টায় অসাধারণ। নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চায় কিছু সংগঠনতো খুবই ভালো ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু ‘ব্যতিক্রম’ কখনো উদাহরণ হতে পারে না। আবার বাংলাদেশের দূতাবাস, কনসাল জেনারেলের কার্যালয় কিংবা নিউ ইয়র্কের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের আয়োজনেও সবপক্ষকে একই ছাতার নিচে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ফলে নিউ ইয়র্কসহ গোটা যুক্তরাষ্ট্র দেখছে বিভক্ত একটি জাতিকে। যদিও একথা বলতেই হবে, ‘ক্ষুদ্র কিছু অংশ’ বাদে, সবপক্ষেরই যার যার মতো করে দেশের প্রতি ভালোবাসা অটুটই রয়েছে। আর এই ভালোবাসা পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাদেশি রয়েছেন, সেখানেই দৃশ্যমান।

নিউ ইয়র্কের কথাই যদি বলি। অনেক সংগঠন রয়েছে এখানে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও বাদ যায়নি। রয়েছে সাহিত্য চর্চার ছায়াতলও। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও থানার নামে সমিতি। রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাই এসোসিয়েশন। এত সংগঠন বাংলাদেশে থাকতেও আমার চোখে পড়েনি।

সবচেযে পীড়াদায়ক যখন এসব সংগঠন নিয়ে দেশের মানুষকে এখানে দলাদলি করতে দেখি। কত দূরের দেশে এসে প্রতিটি মানুষ তার নিজের রক্তঘামের বিনিময়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াচ্ছে। অনেকে এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সেই তারাই নিজেদের মূল্যবান সময়, অর্থ ও শ্রম বিসর্জন দিয়ে সংগঠন করছে। তা তারা করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে নিজেদের জন্যে এক ধরণের প্লাটফর্ম হয়। সুখ দু:খ বিনিময় হয়। ভালোমন্দে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু এত দলাদলি কেন? কেন এত বিভক্তি? বিদেশের মাটিতে কেন মারামারি? একই জেলার কয়টা সমিতি লাগে?

স্থায়ীভাবে বসবাসের আগেও, আমি বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। সাংবাদিকতার কারণে ঘুরেছি অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন গড়ে উঠেছে। অবাক হয়েছি। বাংলাদেশের রাজনীতি এখানে কেন? এখন  অবশ্য নিয়মিত দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

কিন্তু তাদের মাধ্যমে যখন নানান অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে যখন তারা  রীতিমতো মারামারিতে লিপ্ত হন, তখন কোথায় থাকে দেশের ভাবমূর্তি? কেবল তাই নয়, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন সফরে আসেন; একদল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

আবার পাশেই অন্যদল কুৎসিত ভাষার প্লাকার্ড উঁচিয়ে, বাজে ভাষা ব্যবহার করে তার বিরোধীতা করছে। এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ছেন তারা। আমার জানা নেই, পৃথিবীর কয়টি দেশের রাজনৈতিক দল এভাবে শাখা খুলে দেশে দেশে রাজনীতি করছে!

একবার বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়েছিল, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন থাকতে পারবে না। সেই উদ্যোগ কি তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে!

দেখুন, যারা দেশের রাজনীতি এখানে করছেন, তাদের বিরোধীতা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য পরিস্কার। কোন কারণেই জাতি হিসেবে আমরা যেন ছোট না হই, সেটার দিকে দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টাটাও চলুন না এগিয়ে নেই। অনেকে করছেন তো। ভালোও করছেন। একসময় আরও ভালো করবেন। প্রয়োজন সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।  

এবার আসি অন্যান্য প্রসঙ্গে। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক প্রবাসী প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা ধরাও পড়ছে। অনেকে এদেশের আইন ভঙ করছে। অপরাধে জড়িয়ে জেল জরিমানাও মাথায় নিচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের কথা মাথায় রাখা উচিত। ভুল পথ, সবসময়ই ভুল। এসব করে নিজেরাও খারাপ থাকবেন, যেখান থেকে এসেছেন; সেই প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশিত হবে। যা কাম্য নয়। তবে এটিই একমাত্র চিত্র নয়; বেশিরভাগ বাংলাদেশিই প্রচণ্ড পরিশ্রমী। তারা নিজেদের চেষ্টায় সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। সফলও হচ্ছেন। তবে কথাটা বলা, ওই ব্যতিক্রম মানুষগুলোর জন্যে!

‘নেতিবাচক’ এর বাইরে, প্রবাসে একটা উজ্জ্বল বাংলাদেশের উপস্থিতিও রয়েছে। প্রবাসেও দেশের প্রতি আস্থা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ ও শিল্প সংস্কৃতি লালনের প্রচেষ্টা যে অতুলনীয়, সে কথা আগেই বলেছি। কেবল তাই নয়, এমন অনেক বাংলাদেশিই যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন, যারা দেশের মর্যাদাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। দেশের মুখকে উজ্জ্বল করেছেন। নিরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। অনেকে শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একজন। অনেকে খ্যাতিমান চিকিৎসক। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আছেন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়েও। আলোকিত বাংলাদেশিদের অভাব নেই। তাদের সকলকে একত্রিত করে বড় আলোটা জ্বালতে হবে। উদ্যোগটা নিতে হবে কাউকে না কাউকে। লক্ষ্য থাকবে, সেটাই। আর যে যেই দেশেই থাকুন, সেখানকার নিয়ম কানুন মেনে, সেই দেশটার প্রতিও সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই দেশের কোলেই যে আপনার পরম মমতার আশ্রয় হয়েছে।    

এবার আমার কথা বলি। হাজার মাইল দূরে থাকি। কিন্তু 'ভালোবাসা' থাকে খুব কাছে। দেশের প্রতি যে প্রেম; তার বসবাস বুকের মধ্যেই। যে কারণে সর্বত্র দেশকে দেখি। চোখ বন্ধ করলে, কিংবা চোখ খুলেই। প্রখর রোদে, কখনো চোখ ঝলসে যেতে চায়। কখনো ডুবন্ত সূর্যের আড়ালে ধরা পড়ে অদ্ভূত এক দৃশ্য। আকাশে খুব মৃদু ভঙ্গিতে ভেসে বেড়ায় বাংলাদেশের পতাকা। পরম ভালোলাগায় মন ভরে যায়। কখনো স্কুল মাঠে কিংবা অন্য কোথাও দেশের পতাকাই যেন চোখে পড়ে।

প্রিয় দেশ, তুমি ভালো থেকো...আমাকে রেখো তোমার হৃদয় মন্দিরে...মনে রেখো...।

শামীম আল আমিন : লেখক ও সাংবাদিক

ইমেইল: amin.one007@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!