রিটেইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করছে সোনালি ব্যাংক ইউকে

লন্ডনে একমাত্র বাংলাদেশি ব্যাংক সোনালি ব্যাংক ইউকে লিমিটেড রিটেইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করছে।

সৈয়দ নাহাস পাশা যুক্তরাজ্য প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2017, 06:13 PM
Updated : 19 Sept 2017, 06:13 PM

আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকের গ্রাহকরা আর রিটেইল ব্যাংকিং  সেবা পাবেন না বলে এক চিঠিতে গ্রাহকদের গত সপ্তাহে জানিয়ে দিয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে সবাইকে একাউন্ট বন্ধ করে টাকা উঠিয়ে নিতে বলায় এখন লাইন ধরে টাকা উঠাচ্ছেন গ্রাহকরা।

ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরিপূর্ণ ব্যাংকিং সেবা না দিলেও ফরেন কারেন্সি ট্রেডিং চালিয়ে যাবেন তারা।

বাংলাদেশ সরকারের ৫১ শতাংশ মালিকানায় থাকা যুক্তরাজ্যে এই ব্যাংক দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাংকিং সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল। দীর্ঘদিন সেবা দেওয়ার পরে অব্যবস্থাপনার কারণে এটি প্রথম বন্ধ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তখন এটি এক্সচেঞ্জ হাউসে রূপান্তরিত হয়।

দুই বছর এক্সচেঞ্জ হাউস হিসাবে থাকার পরে বিএনপি সরকারের আমলে তখনকার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ফের পরিপূর্ণ ব্যাংক হিসাবে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এর প্রায় ১৬ বছর পর আবারও অব্যবস্থাপনা ও মুদ্রাপাচার ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করছে ব্যাংকটি।

নিয়মকানুন দেখভালে উচ্চ বেতনধারী স্থানীয় কর্মকর্তারা থাকার পরেও গত বছরের অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা গুণতে হয় এই ব্যাংককে। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) এই জরিমানা করে। সে সময় ব্যাংকের এন্টি মানি লন্ডারিং কর্মকর্তা স্টিভেন স্মিথকে ১৭ হাজার ৯০০ পাউন্ড জরিমানা এবং তার এই ধরনের চাকরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এফসিএ।

এই জরিমানার কারণে বিগত প্রায় এক বছরেও ব্যাংক তাদের হাউস অর্ডার নিয়ে আসতে পারেনি।

এখন এটা রিটেইল ব্যাংকিং বন্ধ করে দেওয়ায় যুক্তরাজ্যে সম্পুর্ণ ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী বাংলাদেশি আর কোনো ব্যাংক থাকল না।

স্বাধীনতার পরে যুক্তরাজ্যে উত্তরা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক নিয়ে তিনটি ব্যাংকের শাখা ছিল। পরবর্তীতে সবগুলো তুলে দিয়ে শুধু সরকারি ব্যাংক হিসাবে একমাত্র সোনালী ব্যাংকই চালু থাকে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রবাসীদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যে একমাত্র এই বাংলাদেশি ব্যাংক।

এর আগে ১৯৯৯ সালে সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি কমিউনিটিতে। বাধ্য হয়ে সাধারণ গ্রাহক ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় অনেক ব্যাংকে তাদের একাউন্ট স্থানান্তর করেন। পরবর্তীতে ব্যাংকটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হলেও ব্যবসায়ীরা আবার এখানে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর গ্রাহকদের পাঠানো ব্যাংকের এক চিঠিতে বলা হয়, “আমরা আপনাদের এই মর্মে জানাতে চাই যে, ব্যাংক আমাদের রিটেইল ব্যাংকিং সার্ভিস বিশেষভাবে পর্যালোচনা পরে ব্যক্তিগত একাউন্টের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এর মানে হল, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডে আপনার ব্যক্তিগত একাউন্টটি বন্ধ হয়ে যাবে।”

ব্যাংকের রেমিটেন্স ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যবসা স্বাভাবিক থাকবে। তবে গ্রহকরা তাদের সোনালী ব্যাংকের একাউন্টের মাধ্যমে আর রেমিটেন্স পাঠাতে পারবেন না।

যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের পেনশনের টাকা উঠান। পেনশনার যারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করেন তাদের টাকা এই ব্যাংকের যুক্তরাজ্যের একাউন্টে জমা হয় এবং ব্যাংক সেটি তাদের বাংলাদেশের একাউন্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। রিটেইল ব্যাংকিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন অনেকেই।

অনেক প্রবীণ গ্রাহক আবার পেনশন ছাড়াও তাদের বিভিন্ন সরকারি বেনিফিট এই ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি জমা নেন। এই জমা তারা এখন আর নিতে পারবেন না। এজন্য তাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি বেনিফিট সংস্থাগুলোকে এই ব্যাংকে টাকা না পাঠাতে বলতে হবে এবং অন্যত্র নতুন একাউন্ট খুলে সেখানে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে রিটেইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধের কারণে সেখানে কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৪ জন কর্মীকে ছাঁটাইয়ের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে। ছাঁটাইয়ের নোটিশপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বাঙালি।

সোনালী ব্যাংকের সিইও সারোয়ার হোসেন ছুটিতে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

সোনালী ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, গ্রাহকদের অর্থ চুরি, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি নিয়ে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন হয়েছে। গত অক্টোবরে সোনালী ব্যাংকে নতুন কাস্টমার অর্থাৎ একাউন্ট খোলা ও অর্থ জমা নেওয়ার উপর ১৬৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি। একই সময়ে এন্টি মানি লন্ডারিং ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা থাকার কারণে জরিমানা করে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৬০০ পাউন্ড।

২০১০ সালের ২০ অগাস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত এন্টি মানি লন্ডারিং ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ক্রুটি থাকায় এই জরিমানা করা হয়।

এফসিএর তদন্তে বেরিয়ে আসে, একজন গ্রাহকের অর্থ নিয়ে একটি বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও রেগুলেটরি সংস্থা হিসাবে তাদের জানাতে ব্যর্থ হয় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।