কোরিয়ার চিঠি: উচ্চশিক্ষার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রবাস পাতায় লেখার সুবাদে প্রায় সময়ই অনেক বেশি ইমেইল পেয়ে থাকি, যার বেশিরভাগই থাকে উচ্চশিক্ষার কথা জানতে চেয়ে।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2017, 11:50 AM
Updated : 17 Sept 2017, 03:37 PM

আমি যেহেতু এখানে পড়ালেখার সাথে যুক্ত নই তাই এসবের উত্তর দেবার আগে খুব ভালো করে জেনেশুনে তারপর উত্তর দিয়ে থাকি। তারপরও অনেক বেশি সাধারণ তথ্য সবাই জানতে চায়। কীভাবে কোরিয়া আসা যায়? কোরিয়া আসার উপায় কী? উচ্চশিক্ষার জন্য কী কী করতে হবে? এইসব অনেক কিছু।

আসলে সবাইকে আলাদা করেই এতদিন উত্তর দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি যতোটুকু জানি তার উত্তরগুলো এখানে দিয়ে দেওয়াই ভালো। কিন্তু প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই। কোন ইন্সটিটিউট এর সাথেও আমি যুক্ত নই। আমি এখানে আমার হাজবেন্ড এর পড়ালেখার সুবাদে থেকে, দেখে ও নিজের উচ্চশিক্ষার জন্য খোঁজখবর নিতে গিয়ে যা জেনেছি ওই অভিজ্ঞতা থেকেই উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।

আর যেসব প্রশ্ন আপনারা করেছেন তার অনেক উত্তর আমার সঠিকভাবে জানা ছিল না। সেজন্য আমি এখানে অবস্থান করা বড় ভাই এবং ছোট ভাইদের থেকে জেনে কিছু কমন প্রশ্নের উত্তর জানাচ্ছি। তারা এখান থেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি শেষ করে এখানেই রিসার্চ করছেন। এ ব্যপারে শোয়েব আমাকে অনেক সাহায্য করেছে সঠিক তথ্য দিয়ে।

আশরাফ হোসেন রাসেল

আমি আমার লেখার শুরু থেকেই পড়ালেখার বিষয়ে অনেক তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখনও করছি। আশা করি এখন আপনাদের অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।

দক্ষিণ কোরিয়া কীভাবে আসা যায়? সবচেয়ে ভালো উপায় কোনটি? 

উত্তরটা খুবই সহজ। পড়ালেখা অথবা চাকরির সুবাদে। উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি মানে স্কলারশিপ নিয়ে অথবা নিজের খরচে পড়ালেখা করার জন্য এখানে আসতে পারেন। স্কলারশিপ নিয়ে আসাটাই সবচেয়ে ভালো। অনার্স,  মাস্টার্স বা পিএইচডি যে কোনটার জন্য আপনি আসতে পারবেন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আপনার দক্ষতা থাকে।

উচ্চশিক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া আসতে কার্যপ্রণালী বা প্রক্রিয়া কী?

দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে প্রফেসর ম্যানেজ করা। প্রফেসর যদি রাজি থাকেন আপনাকে নিতে তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। সেজন্য প্রথমে আপনার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার বিষয়ের ডিপার্টমেন্ট খুঁজে বের করলে দেখতে পাবেন প্রফেসরদের নাম।

তারপর প্রফেসরদের ওয়েবসাইটে গেলেই বুঝতে পারবেন তারা কোন বিষয়ে পারদর্শী এবং বর্তমানে তারা কী নিয়ে কাজ করছেন। সেখান থেকে আপনি কার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী তাকে সুন্দর করে গুছিয়ে একটা কভার লেটার লিখে সিভিসহ আপনি ওই প্রফেসরকে ইমেইল করে দেবেন। কভার লেটারে এতটুকু বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, আপনি তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী এবং কাজের প্রতি আপনি কতটুকু বিশ্বস্ত।

ব্যস, এটুকুই কাজ। প্রফেসর যদি আপনাকে নিতে আগ্রহী হয় তারপর কী করতে হবে তা প্রফেসরই আপনাকে গাইড করবে। এখন ওয়েবসাইট বের করা, কভার লেটার লেখা এসব আপনাকে নিজে থেকেই করতে হবে। আপনি সাহায্য নিতে পারেন পরিচিত বড় কারো অথবা আপনার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে। কিন্তু বেসিক কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে।

আইইএলটিএস (ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট সিস্টেম) লাগবে কিনা?

এক কথায় অবশ্যই। কোরিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস অবশ্যই দিয়ে আসতে হবে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫.৫ আর কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬.৫। এটা আসলে নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবশ্যিক শর্তের উপর।

স্কলারশিপ কীভাবে পাওয়া যায়?

সরকারি স্কলারশিপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ দুই-ই এখানে পাওয়া যায়। সরকারি যে স্কলারশিপ তার খবর বাংলাদেশের পত্রিকাতে পাওয়া যাবে যেটাকে সংক্ষেপে কেজিএসপি বলে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্কলারশিপগুলো ওই ব্যপারে আপনি কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ’ অপশনে গেলেই দেখতে পাবেন যে স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য কী কী করতে হবে।

উচ্চশিক্ষার জন্য অধ্যায়ন বিরতি মানে স্টাডি গ্যপ থাকলে কোনো সমস্যা হবে কিনা ?

এটা আসলে কোন সমস্যা নয়। প্রফেসর ম্যনেজ করতে পারলে স্টাডি গ্যপ থাকলেও সমস্যা হওয়ার কথা না।

কোন প্রতিষ্ঠান বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো?

এই ব্যপারে আমার কোন ধারনা নেই। যদি সত্যিই আপনি বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে চান তাহলে নিজে থেকেই সব খোঁজখবর নিয়ে আসা ভালো। আর এখন গুগল করলেই কিন্তু আপনি ৯০% উত্তর পেয়ে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে কেন আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে যাবেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর আপনার যোগ্যতা থাকলে আপনি নিজে থেকে চেষ্টা করলে পাবেন। আর দেশের বাইরে পড়ালেখার জন্য আবেদন থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়াই তো অনলাইনেই হয়ে থাকে।

যতোটুকু সময় আপনি প্রতিষ্ঠানের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করবেন তার থেকে ভালো হয় নিজে নিজে খুঁজে বের করে সব প্রয়োজনীয় কাজগপত্র জোগাড় করে নিজেই আবেদন করা।

কোরিয়াতে উচ্চশক্ষার জন্য যেতে হলে কোরিয়ান ভাষা জানাটা জরুরি কিনা ?

মাহবুবুল আলম শোয়েব

যারা সায়েন্স এর বিষয়গুলোতে পড়তে আসে তাদের জন্য আসলে কোরিয়ান ভাষা জানাটা জরুরি না। মানে, না জানলে সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কেউ আর্টস থেকে পড়তে আসতে চায় সেক্ষেত্রে কোরিয়ান জানা থাকলে খুব ভালো।

ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে পড়তে আসা যায় কিনা ?

হ্যাঁ, আসা যাবে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব না। হাতে গোনা ১/২টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা সম্ভব। যেমন হাঙ্কুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেইন স্টাডিজ ( হাফস)। এখানে এই বিষয়ের উপর উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

আর্টস এর সাবজেক্ট অর্থনীতি, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কতোখানি সুযোগ আছে?

সত্যি বলতে আর্টস থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য এখানে সুযোগ অনেক কম। কেননা, এইসব বিষয়ে স্কলারশিপ পাওয়া কষ্টকর। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ইংরেজিতে মাস্টার্স করার জন্য। কিন্তু হয়নি। আর যদি নিজে টিউশন ফি দিয়ে পড়তে চান তাহলে প্রথমেই আপনাকে কোরিয়ান ভাষা খুব ভালো করে শিখতে হবে। তবে হ্যাঁ, আপনি এমবিএ করতে পারবেন এখানে।

কৃষি অনুষদ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য সুযোগ কেমন?

কৃষিতে পড়ার সুযোগ আছে, কিন্তু আপনাকে নিজেকেই তা খুঁজে নিতে হবে। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্ক চান, তাহলে তো সমস্যা। সবই যদি অন্যরা করে দেয় তাহলে তো আপনার নিজস্ব কিছু থাকলো না। তাই না!

ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন?

ইঞ্জিনিয়ারিং যেহেতু সায়েন্স এর বিষয়। সেক্ষেত্রে সুযোগ তো আছেই।

স্কলারশিপ এর খবরগুলো কীভাবে পাবো?

একটা সিম্পল জিনিস চিন্তা করেন। যদি কেউ ইউরোপ অথবা আমেরিকাতে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চায় তাহলে প্রথমেই তারা কী করে? হ্যাঁ, অনলাইনে সার্চ করে খুঁজে বের করে। ঠিক তেমনটাই আপনাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য করতে হবে। স্কলারশিপের সার্কুলারগুলো আপনাকে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে গিয়ে খুঁজতে হবে। কোরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

রূপম কুমার দাশ

আমার আগের কিছু লেখায় আমাদের প্রিয় দূতাবাস সম্পর্কে আমি বিস্তারিত বলেছিলাম। তাদের ফেইসবুক পেইজে, ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব কোরিয়া’ এর ফেইসবুক পেইজে এখানকার বিভিন্ন স্কলারশিপ সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া ফেইসবুকে কিছু পেইজ আছে যারা উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ এবং এই ব্যপারে অনেক সাহায্য করে থাকে। ওইসব কিছু পেইজ এর লিঙ্ক আমি লেখার নিচে দিয়েছি। ওইখান থেকেও আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধৈর্যশীল হতে হবে। এসব বিষয়ে সময়ের ব্যাপার। এরপর হচ্ছে, নিজেই নিজের জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। এসব কাজ কেউ কারও জন্য করে দিতে পারে না। সাহায্য করবে সবাই, কিন্তু আসল কাজটা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে। উচ্চশিক্ষা আসলে অনেক বড় একটা ব্যপার। আর বাইরের মাস্টার্স মানেই দুই বছর। ফুল টাইম জবের মতো। ক্লাস শেষ করার পর থেকেই আপনাকে সময় দিতে হবে রিসার্চে। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসলে তো চিন্তাই নেই।

যতটুকু তথ্য মানে ইনফরমেশন পাবেন তার সঠিক ব্যবহার আপনার নিজেকেই করতে হবে। যদি সত্যিই আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে দায়িত্বটা কিন্তু আপনার নিজেরই। পরিচিত মানুষ শুধু আপনাকে পথটাই দেখিয়ে অথবা বলে দিতে পারবে, আর কিছু কিন্তু তারা পারবে না। নিজের প্রতি দায়িত্ববোধটাকে কাজে লাগিয়ে আপনাকেই এগিয়ে যেতে হবে। মৌলিক ধারণাগুলো শুধু অন্যরা বা আপনার আশপাশের মানুষ আপনাকে দিতে পারবে। কাজগুলো কিন্তু আপনার নিজের। সেক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করতে ধৈর্যশীল হতে হবে অবশ্যই।

শাহেদ উদ্দিন আহমেদ সজীব

একটা টার্গেট ফিক্স করে নিন যে, কোন বছরের কোন সেমিস্টার থেকে আপনি আপনার স্টাডি শুরু করে ইচ্ছুক। ওই অনুযায়ী বেশ খানিকটা সময় হাতে নিয়ে কাজ শুরু করে দিন।

উচ্চ শিক্ষার জন্য বেশ কিছু ফেইসবুক পেইজ আছে যারা স্বেচ্ছায় সবাইকে সাহায্য করে থাকে। এসব পেইজ থেকেও অনেক হেল্প পাবেন আশা করি। আমি কিছু লিঙ্ক নিচে দিয়ে দিচ্ছি, সাথে একটা ইউনিভার্সিটি লিঙ্ক।

সবশেষে আমাকে এতোসব তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য রাসেল ভাইয়াকে অনেক ধন্যবাদ। সাথে সজীব, রূপম আর শোয়েবকেও অনেক ধন্যবাদ।

লিংক-

১ https://www.facebook.com/groups/HSA.SouthKorea/

২ http://www.bsak.org/

৩ https://www.facebook.com/Hi.BSAK/

৪ https://www.dropbox.com/s/cfpga9l6q6a3nto/Ewha%20Womans%20University%20Spring%202018.pdf?dl=0

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!