প্রবাসের চিঠি: রোমান্টিক শহর, তালার বহর

প্যারিসকে কেউ বলেন রোমান্টিক শহর। কেউ বলেন ভালোবাসার শহর। আর আমি মজা করে বলি ‘তালার শহর’।

নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2017, 08:09 AM
Updated : 15 Sept 2017, 08:29 AM

গল্পের শুরুতে বলতে চাই প্যারিস ভ্রমণের কিছু নিয়মাবলী। প্যারিস যাবেন ভালো কথা। কিন্তু ওখানে গিয়ে লাগাবেন না ভালোবাসার তালা। আর তালা না লাগালেই প্যারিস কর্তৃপক্ষ হবেন একটু বেশিই খুশি। শহর কর্তৃপক্ষের স্লোগান হচ্ছে- ‘তোমাদের ভালোবাসাকে মুক্ত করে দাও, আমাদের ব্রিজগুলোকে বাঁচাও।’

এখন সিরিয়াস কিছু বলি। আর যদি লাগাতেই চান তালা, তাহলে উপর-নিচে একটু তাকিয়ে লাগাবেন। ধরা পরলে একশ’ ডলার জরিমানা লেখা আছে ওখানে।

চলুন এবার প্যারিস যাই। জার্মানি থেকে চেক প্রজাতন্ত্র বেড়ানো শেষে টিকেট কিনলাম উইজ এয়ার বিমানের। কম দামি টিকেট, তাই বিমানের পক্ষ থেকে নেই কোনো চা-নাস্তার ব্যবস্থা। নিজের কলা খেতে খেতেই পৌঁছে গেলাম প্যারিসে। মেঘেঢাকা প্যারিসের আকাশ ও নিরাপত্তার চাদরে মোড়া প্যারিসের চারপাশ। একি, আমার প্যারিস আগমনে এত আয়োজন! না না। প্যারিসের দৈনিক চিত্রই এখন এমন!

যার জন্য প্যারিস আসা সেই আইফেল টাওয়ারের অর্ধেকটা দেখা হয়ে গেছে আকাশ থেকে বিমানে বসেই, আর বাকি অর্ধেক দেখে নেবো সময় করে। এই পরিকল্পনা নিয়েই আমার প্যারিস ভ্রমণ শুরু। যে ভ্রমণ করে সে খেয়ে-দেয়েই করে। যে দেশে ভ্রমণ সে দেশের খাবার। দুনিয়া বিখ্যাত ফ্রেন্স বাগেট আর ফ্রেন্স চিজ দিয়ে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা। প্যারিসে রাস্তায় দাঁড়ানো রিকশা। না, রিকশা করে প্যারিস ঘুরবো না। রিকসা তো বাংলাদেশের চিজ, ফ্রান্সের না।

প্যারিস গাইডবুক অনুযায়ী পাতাল ট্রেন আর মেট্রো ট্রেন চড়ে অর্ধেক পথ আর হেঁটে বাকি পথ গেলে নাকি যাওয়া যাবে আইফেল টাওয়ার। কিন্তু প্যারিসের ট্রেন লাইনের মানচিত্র বুঝতে বুঝতে হয়তো পুরো পথ হেঁটেই যাওয়া যাবে আইফেল টাওয়ারে। প্যারিসে নতুন এসে পাতাল ট্রেন আর মেট্রো ট্রেনের মানচিত্র দেখে যে কেউরই ঘুরবে মাথা। ভুল করে ভুল ট্রেনে চড়ে বসে নেমে গেলাম ভুল স্টেশনে।

দূর থেকে আইফেল টাওয়ারের মাথা লক্ষ্য করে সিন নদীর তীর ধরে হাঁটছিলাম। কেউ একজন পেছন থেকে ডাক দিলেন ‘হ্যালো’ বলে। ফিরে দেখি একজন মধ্যবয়সী মহিলা। আমি কিছু বলার আগেই তিনি আমার হাতে একটি স্বর্ণ রঙের আংটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয় এটা আপনার আংটি? নিয়ে নিন।’ আমি বললাম, ‘না, এটা আমার নয়, অন্য কারো হবে।’ উনি বললেন, ‘এটি একটি স্বর্ণের আংটি। আপনি নিয়ে যান সমস্যা নেই।’

আংটিসহ হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে ‘হ্যালো’ বলে আবার ডাক। সেই একই মহিলা বললেন, ‘স্বর্ণের আংটি নিয়ে যাবেন কিছু দিয়ে যাবেন না?’ কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধুই তাকাচ্ছিলাম। একটু একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। বললেন, ‘কিছু  ইউরো আমাকে  দাও, আর আংটিটা নিয়ে যাও।’ আমি আংটি মাটির মধ্যে রেখে দিলাম এক দৌড়। আলজেরিয়ান, রুমান, জিপসি আর আফ্রিকানদের রাখিবন্ধন পড়ানোর গল্প ও প্যারিসের মলমপার্টি সম্পর্কে আগে থেকেই আমার কিছুটা ধারণা ছিল।

সিন নদীর ঘোলা পানি আর নদীতে পর্যটকভর্তি চলন্ত বোট দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আইফেল টাওয়ার। আইফেল টাওয়ার সংলগ্ন রাস্তায় দু’জন, আর টওয়ারের চার কোণায় চারজন মোটা বন্দুক নিয়ে পাহারাদার, যেনো কেউ টওয়ারের সঙ্গে ছবি তুলতে না পারে। দেখলে যে কারো এমনটাই মনে হতে পারে। আইফেল টাওয়ার উচ্চতায় ৩২৪ মিটার এবং বয়স ১২৮ বছর।

টাওয়ারের একদম নিচ থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে চমৎকার কিছু ছবি তুলে দিলেন ভ্রমণবন্ধু্ জার্মানির ফ্রানজিসকা। প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন জায়গাগুলো এবং যে মিজিয়ামে মোনালিসার আসল ছবি রাখা আছে সেই মিজিয়ামেও ঘুরলাম ও ছবি উঠালাম মিউজিয়ামের সামনে গ্লাসের তৈরি পিরামিডের সাথে।

তালা ব্রিজ, যেখানে ভালোবাসার তালা লাগানো হয় এটাও প্যারিসের একটি দর্শনীয় স্থান। যেখানে  পাগলারা লাগায় ভালবাসার তালা, আর চাবি ফেলা হয় ব্রিজের নিচে নদীতে। রঙের এই দুনিয়াতে কতো ঢঙের মানুষ বানিয়েছে আল্লাহ। শত বছরের এই তালার খেলা যে শুধু প্যারিসেই সীমাবদ্ধ তা নয়। সে কবেই এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপে। পাগলরা যেখানেই খালি জায়গা পায়, সেখানেই লাগায় তালা।

প্রতিদিনই লাগানো হচ্ছে তালা। দেশি-বিদেশি ছোট-বড় তালা। প্রিয়জনকে আজীবন ধরে রাখার তালা। স্বর্গ থেকে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে। তালা মেরে আজ পর্যন্ত ধরে রাখতেইবা পেরেছেন কয়জন? এতো শুধু পাগলদেরই খেলা। তালায় অতিষ্ঠ শহর কর্তৃপক্ষ। এতো তালার ভার বইতে না পেরে ব্রিজের কিছু অংশ ভেঙ্গে নদীতে পড়ে গেলে প্যারিস কর্তৃপক্ষ ব্রিজগুলোর দু’পাশের চারদিকে হার্ডবোর্ড লাগিয়ে দেন, যাতে আর কেউ তালা না লাগাতে পারে।

কর্তৃপক্ষ এরকম লিখে সাইনবোর্ডও ঝুলিয়েছেন, ‘ফ্রি ইউর লাভ, সেভ আওয়ার ব্রিজ’। কে শুনে কার কথা! এখন নদীর পাশ ঘেঁষে যাওয়া গ্রিলেও লাগানো হচ্ছে তালা। হয়তো এই তালা-তালা খেলা চলবে, প্রেম পাগলারা যতদিন এই দুনিয়ায় থাকবে।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল- md.naim@aol.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক ও তার বন্ধু ফ্রানজিসকা

এই লেখকের আরও লেখা