তখন এই হাকনে ভ্রমণের অনেক কিছুই লিখেছিলাম। জাপানি বধূকে নিয়ে আমার সম্ভবত এটাই ছিল প্রথম এভাবে ঘোরাঘুরি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাকনে আমাদের এই ভ্রমণ ছিল সত্যিই বেশ রোমাঞ্চকর। সেই ভ্রমণের উপর লেখা লিখে পরবর্তীতে প্রকাশের জন্য কোথাও কোন পত্রিকায় পাঠানো হয়নি। কম্পিউটার বদলানোর কারণে সেই লেখার হদিস এখন আর নেই।
সকালে যখন পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্য উঁকি দেবার দৃশ্য চোখে পড়লো তখনই চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করেছিলাম ঘুমানোর জন্য। চোখ বন্ধ করে কি আর থাকা যায়? আশপাশে লোকজনের আনাগোনা, গাড়ির শব্দ, সে সাথে গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির করে ডাকাডাকির শব্দে আমি বেশি সময় আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারিনি। চোখ খুলে দেখি আশপাশে ভ্রমণ বিলাসীদের ভিড় জমছে।
আমি উঠে লেকের পার চলে গেলাম আমার সফরসঙ্গী ফটোগ্রাফার সহিদুল হকের খোঁজ করতে। এদিক সেদিক তাকিয়ে কোথাও তার দেখা পেলাম না। তাকে না পেয়ে একা একাই লেকের পার হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল তখন আমার। চারদিকের দৃশ্য দেখে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেক দূরে চলে গেলাম। সকালের রোদ কতদিন চোখে পড়েনি! হালকা বাতাস, পাহাড়ে গাছগাছালির সবুজ পাতার রঙে চোখ যতদূর যায় পুরোটাই সবুজ হয়ে পাশে লেকের পানিকেও সবুজ দেখাচ্ছিল। কোনটাই শরীর, স্বাস্থ্য এবং মনের বিপরীতে নয়। প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম তখন আমি।
এত সকালে কোন কিছুই সেখানে তখন শুরু হয়নি। ঘাটে বিশাল বড় শিপ বাঁধা। ছোট ছোট রং বেরঙের ডিঙ্গি নৌকা ঘাটে বাঁধা রয়েছে দেখে সেগুলোর কাছে গিয়ে একবার দাঁড়িয়ে চড়ার কথা ভাবলাম। নৌকাগুলো দেখছিলাম আর ছোট সময়ে পতেঙ্গায় সাম্পানে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে করলাম। এরপর আমি মোবাইলে কিছু ছবি তুলে নিলাম স্মৃতি হিসেবে। এরপর সামনে যেতেই দেখি সহিদুল আমার দিকে হেঁটে আসছেন।
সকালে নাস্তা করা দরকার। সহিদুল হককে মনে করিয়ে দিলাম আমার মেডিসিন নেবার কথা। এরপর বললেন, চলেন হেঁটে যাই, সামনেই কনভেনিয়েন্স স্টোর। পুরো এলাকা একবার ঘুরে দেখে পাহাড়ের উল্টো দিকে কনভেনিয়েন্স স্টোর আছে ওখান থেকে নাস্তা কিনে আবার গাড়িতে এসে খাই।
দৃশ্য দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, রাতের হাকনে জাতীয় পার্কের দৃশ্য আর ভোরের দৃশ্য কতটা যে ভিন্ন আমি এখানে রাত না কাটালে কখনোই বুঝতে পারতাম না। দেখছি আর ভাবছি এই রাতে যদি সঙ্গে থাকতো পাখি, তাহলে কতই না মজা হতো। হা হা হা।
একসময় আমি জাপানে অনেক পাহাড় বেয়েছি। দেশেও ময়মনসিংহ গারো এলাকা, চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ওপারে দিয়াং শহর ও মেরিন একাডেমিতে বেড়াতে গিয়ে অনেক পাহাড় বেয়েছি। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার মজাই যেন আলাদা। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার সময় জীবনটাকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ-চ্যালেঞ্জ মনে হয়। সেসব দিনের কথা মনে করলেও এখন যে বয়স আর অসুস্থতা আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। বলা যায়, আগে চলতাম গায়ের জোরে আর এখন চলি আমি মনের জোরে। তাও যে পারি না!
শোয়া থেকে উঠে কিছু সময় তাকিয়ে দেখলাম সেই ফুজি পাহাড়ের চূড়া। সাদা মেঘরাশি এসে ফুজি পাহাড়ের গা জড়িয়ে ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেনো সদ্য যৌবনা কোন মেয়ে তার ভালোবাসার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গণ করছে। চমৎকার সেই দৃশ্য দেখে সাথে সাথে ফেইসবুকের আইডিতে গিয়ে লাইভ করা শুরু করলাম। এত সকালেই দেখি কেউ কেউ আমার সেই লাইভ করা দেখে কমেন্ট করছিলেন। জানতে চাইছিলেন আমার অবস্থান কোথায়? কোথা থেকে এই লাইভ করছি। জানালাম আমার ধারাবিবরণীতে আমি কোথায় আছি আর কী দেখাচ্ছি। তখনো শরীর আমার চলছিল না। তাই যতটা সময় পেরেছি সরাসরি দেখালাম। এরপর কিছু স্টিল ছবি তুলে সেখান থেকে নামতে থাকি আস্তে ধীরে। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় সেখানে শুরু হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ আগেই তার প্রমাণ অবশ্য আমি দেখেছি। কয়েকজন লোক এই বনের ভেতর এসে ফুলগাছ ছাঁটছিল আর মজে যাওয়া ফুল গাছ থেকে ছিঁড়ে কীভাবে যে পরিচর্যা করছিল, তাদের কাজের মধ্যে কোন ধরনের ফাঁকিবাজির লক্ষণ দেখা যায়নি। ওরা এত বড় বনে কাজগুলো না করে বসে থাকতে পারতো, কিংবা ফাঁকি দিয়ে মাস শেষে বেতন নিতে পারতো। কিন্তু সচেতনতা বোধ যে ওদের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করে, যে কারণে আমার চিন্তাকে ওরা মিথ্যা প্রমাণ করলো।
কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে উঠে এলাম। সেখান থেকে আবার পাহাড় বাইতে হবে। না হলে বড় রাস্তায় যাওয়া যে সম্ভব না। এমন এক জায়গাতে এসে থেমে গেলাম যেখান থেকে সামনে পেছনে যেদিকে যাই সেই সমান পাহাড়ই আমাকে বাইতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে বড় রস্তা। দূর থেকে দেখলাম লেকে পর্যটকদের নিয়ে জাহাজ চলতে শুরু করছে। ছোট সাম্পানগুলোও পানিতে ভাসছে শুরু করেছে। দেখে লোভ জাগলো চড়ার। শরীরের কথা ভেবেই লোভকে সংযম করলাম আমি।
দূরে তাকিয়ে দেখলাম রুফ ওয়ে উপরের দিকে উঠছে। এসব দেখেও এখন আর ওগুলোতে চড়ার কোন ইচ্ছে নেই। শখ অনেক বছর আগেই মিটিয়েছি। সর্বশেষ আমার জাপানি বধূকে নিয়েই যখন এখানে এসেছিলাম তখন এসবে চড়ে বেড়িয়েছি অনেক। এখানকার রুফ ওয়েতে চড়তে জন প্রতি একহাজার ইয়েন দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। উপরে উঠে, সেখানেও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে খাবারের রেস্টুরেন্টসহ আরো অনেক কিছু। ভ্রমণ বিলাসীরা ওখানে উঠে ইচ্ছেমতো ঘুরে এরপর আবার ফিরতি টিকিট দেখিয়ে নেমে আসে।
কিছু সময় সেখানে পানির ধারে দাঁড়িয়ে থেকে রঙ-বেরঙের মাছের খেলা দেখে সামনে এগুতে থাকলাম। টের পেলাম রাস্তায় গাড়ির শব্দ। খুব কাছেই চোখে পড়লো বিদেশি পর্যটকদের অনেককে। কারো হাতে ক্যামেরা। তাদের কারো মনে আর মুখে রসিকতা লাফাচ্ছিল। আমরা ওদের রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। সামনেই চব্বিশ ঘণ্টার কনভেনিয়েন্স স্টোর। সেখানে ঢুকে সকালের নাস্তা কেনা পর্যন্ত সময় ধৈর্য ধরলাম। এরপর বাইরে এসেই সহিদুলকে রেখে খেতে শুরু করে দিলাম।
আমার কথা শুনে সহিদুল হক চলে গেলেন গাড়ির কাছে, গাড়ি নিয়ে আসতে। আমি মাটিতেই পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। যে সময়ের মধ্যে সহিদুলের ফিরে আসার কথা, সেই সময়ের মধ্যে সে ফিরেনি। আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ পর সে এসে হাজির হলে তাড়াতড়ি করে গড়িতে চড়ে ইনস্যুলিন বের করে পেটের কাপড় তুলে আগে নাভির পাশে পুশ করে নিলাম। সহিদুল আমার জন্য বিভিন্ন ব্রুশিউর নিয়ে এসেছেন। আমি সেগুলো ব্যাগে ভরে বললাম, এবার আমি গাড়ি ড্রাইভ করবো। সহিদুল নিজেই ড্রাইভ করার কথা বলে আমাকে রেস্ট নিতে বললেন।
গাড়ি নিয়ে এরপর যতটা সম্ভব হাকনে জাতীয় পার্কে ঘুরে বেড়ালাম। কোথাও আর নেমে দেখার আগ্রহ তখন হয়নি। যতটা সম্ভব গাড়ি নিয়েই আমরা ঘুরে দেখে দু’জনে চলে গেলাম অন্য জায়গায়। যাবার সময় আবার ফেইসবুকে লাইভ অপশনে গিয়ে অন্যদের সেখানকার রাস্তা-ঘাট দেখানোর চেষ্টা করলাম। অনেকটা ফল হলো। খেয়াল করে দেখি, অনেকেই আমার সরাসরি প্রোগ্রাম দেখছিলেন।
গাড়ি চলতে চলতে গিয়ে পৌঁছলাম কানাগাওয়া প্রিফেকচারের ‘তানা’ মসজিদে। সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে সহিদুল আমাকে কাছের রেল স্টেশনে পৌঁছে দিলে আমি ট্রেনে চড়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো পাহাড়ের পাদদেশে রাত কাটিয়ে। ভোরের দৃশ্য দেখা হলো। আর সারাদিন কাটালাম সেই হাকনের পাহাড়ের আশপাশের রাস্তায় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি দেখে।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |