কানাডার চিঠি: নিরাশ্রয় নও তুমি আপন পৃথিবীতে

অং সান সু চির দেশে আজ মানবতা পদদলিত। শান্তির নোবেল আজ কলঙ্কিত। মানবতাবাদী, গণতন্ত্রকামী ও শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নারী আজ বড় নির্দয়, স্বার্থপর।

সুশান্ত বড়ুয়া, কানাডার মন্ট্রিয়েল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2017, 10:45 AM
Updated : 12 Sept 2017, 10:46 AM

ছোটবেলায় পত্রিকায় যার জীবনী পড়ে একদিন বড় হয়ে তার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, আজকের এই দিনে ভাবতে অবাক লাগে, এই কি সেই অং সান সু চি! সময়ের পরিবর্তন বড় নিষ্ঠুর। সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিধন করার যে অপপ্রয়াস মিয়ানমার সরকার ও তার সেনাবাহিনী করছে তা বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে দিলো। সভ্যতার এমন আধুনিক সময়ে এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন মেনে নেওয়া যায় না।

একদিকে সিরিয়া অন্যদিকে মিয়ানমার, যেখানে গণহত্যা চলছে নির্বিচারে। যখন যার ইচ্ছে সে বোম ফেলে সিরিয়াতে। শেষ করে দিচ্ছে নিরহ মানুষগুলোকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। পাশা খেলার মতো দেশটাকে ধ্বংস করে দিলো। সেই ঘাত শেষ না হতেই মিয়ানমারে আরেক নিষ্ঠুর নির্যাতন দেখে হতবাক হয়ে পড়ি। রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যা পৃথিবীর কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারছে না, পারবে না।

আর সেই জঘন্যতম নির্যাতনটি হচ্ছে অং সান সু চির দেশে ও সু চির সন্ত্রাস দমনের ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে যা আরো বিস্মিত করে আমাকে আর পৃথিবীর বিবেকবান মানুষদের। মানুষ কীভাবে এতো পাষাণ হতে পারে, ভাবতে অবাক লাগে! তাও আবার সু চির মতো মানুষ! সন্ত্রাস দমন মানে মানুষ হত্যা হতে পারে না। যারা সন্ত্রাসী তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওয়াতায় আনা যেতে পারে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ জঙ্গি দমন করছে, তার মানে জঙ্গিদের মা-বোন, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে হত্যা করছে না। 

সু চি ও পৃথিবীর তাবৎ দেশের নেতাদের আজ শেখার আছে বাংলাদেশের কাছ থেকে। ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ সত্যি রোহিঙ্গাদের সংগঠন নাকি বানানো তা নিয়েও আছে সংশয়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে যে মুহূর্তে শান্তি প্রস্তাব পেশ করা হলো ঠিক সে প্রস্তাব পেশের চার ঘণ্টার মধ্যে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ মিয়ানমারের আর্মি ও পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলা করেছে, হত্যা করেছে। এ কোন সভ্য মানুষ মেনে নেবে না। কিন্তু এই সূত্র ধরে পুরো রোহিঙ্গা জাতি নির্যাতিত হতে পারে না।

রোহিঙ্গারা মুসলিম, তবে তা বড় পরিচয় নয়। তার চেয়ে বড় পরিচয় তারা মানুষ, তারা মানব। আর তাদের হত্যা করা মানে মানবতাকে হত্যা করা। ধর্ম আজ বড় পরিচয় নয়। মানবতাকে যেভাবে পদদলিত করা হচ্ছে সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানবতাবাদী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আওয়াজ তোলার সময় হয়েছে। কালে কালে যেন হিটলাদের জন্ম না হয়।

এই রোহিঙ্গা সমস্যাকে কোন কোন পত্রিকা, টিভি মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিম, বৌদ্ধ শব্দ ব্যবহার করে জাতিগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে কিছু সাম্প্রদায়িক ফায়দা নিতে চায় কেউ কেউ। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের এতো বড় সমস্যা তা কোন জাতির বা ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা আজ সারা বিশ্বে সব মানুষের কাছে, সব জাতির কাছে মানবতার সমস্যা।

তাই বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা নোবেল বিজয়ী দালাইলামা নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে সু চিকে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে চিঠি লিখেছেন। মিয়ানমার সরকার ও রোহিঙ্গাদের এই সমস্যা আজ তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মানবতা যখন পদদলিত তখন তা রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে।

তাই আজ আমরা সবাই একসঙ্গে এর প্রতিবাদ করবো। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সেই বিভাজন করার সময় ফুরিয়ে গেছে। আমরা মানবতার পক্ষে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ করবো। জয় হোক মানবতার। আপন পৃথিবীতে নিরাশ্রয় হতে পারে না মানুষ।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ কানাডা প্রেস ক্লাব, প্রবাসী বাংলাদেশি

ই-মেইল: susant_123@yahoo.co.in

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!