৪৮ ঘণ্টার দীর্ঘ সফর: ঢাকা, সিঙ্গাপুর, লন্ডন ও গ্লাসগো

ইরাসমাস শিক্ষার্থীরা যেখানে দুই সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের ভিসা পায়, সেখানে আমার ভিসা পেতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। অথচ আমার ভিসা তো অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার কথা!

রকিবুল হাসান, স্কটল্যান্ড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2017, 09:43 AM
Updated : 10 Sept 2017, 09:43 AM

কুইন্স ইয়ং লিডার, রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটি ফেলো ও কমনওয়েলথ পিস অ্যাম্বাসেডর হয়েও কোনকিছু কাজে আসছিলো না। প্রথমবারের মতো এই সম্মাননাগুলো অর্থহীন মনে হচ্ছিল। বিরক্তি, লজ্জা ও ভয়ে নিশ্চুপ হয়েছিলাম। কারণ গতবার আমেরিকার জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পাওয়ার পরও ইউএস ভিসা না পাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারিনি। এবারও একই ভয় আমাকে কাবু করে ফেলছিলো।

অবশেষে অগাস্টের ২৭ তারিখে ভিসা পেয়ে ৩০ তারিখ তড়িঘড়ি করে যুক্তরাজ্যে চলে আসি। কেনাকাটা করা হয়নি। অনেকের সঙ্গে দেখাও হয়নি। এমনকি একটু ফোন পর্যন্ত করা হয়নি। বরিশালে যাওয়া হয়নি। দাদার কবর যিয়ারত করার কথা ছিল। সিলেট, রাজশাহী ও খুলনার তরুণদের সঙ্গেও দেখা করার কথা ছিল। আমার ইনবক্স অভিমান-অভিযোগে ভরে গেছে, অনেকেই ক্ষুব্ধ। আর আমি এ-ও জানি, বিক্ষুব্ধরাই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। ক্লাস শুরু হওয়াতে এমন তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হলো। আগে বিদেশে আসতে ভালো লাগত, এবার কেন জানি ভীষণ খারাপ লাগছে আপনাদের ছেড়ে আসতে।

ঢাকা থেকে স্কটল্যান্ডের সব বিমানের টিকিট ফুরিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে লন্ডনের একটা টিকিট পেয়ে যাই। মাত্র তিনদিন আগে প্রায় দ্বিগুণ দাম দিয়ে টিকিট কিনি। সবচেয়ে পেছনের আসন। পাশে বসে এক ভদ্রলোক। ষাটোর্ধ্ব, চোখগুলো টকটকে লাল ও এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলতেন। অগোছালো কথা। অকারণে খিলখিল করে হাসতেনও।

তিন দিনের ম্যারাথন প্রস্তুতিতে আমি তখন নুইয়ে পড়েছি, নিজের অজান্তেই ক্লান্ত চোখজোড়া ঘুমিয়ে পড়েছে বেহুশের মতো। ঠিক তখনি বয়ষ্ক লোকটি পাশ থেকে বিকট চিৎকার করতেন তার এলোমেলো কথা শোনাবার জন্য। আমি তখন বুঝে যাই, ভদ্রলোক হয়তো মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। ৪ ঘণ্টায় তিনি কমপক্ষে তিনবার উচ্চশব্দে চেঁচিয়েছেন। সবাই বিরক্ত, অন্যপাশের এক ভদ্রমহিলা বিমানবালাকে নালিশ করতে চাইলে আমি বারণ করে থামিয়ে দেই। নিরুপায় হয়ে পুরো চার ঘণ্টা চাচার কথা শুনি।

চাচা উর্দু-বাংলা-ইংরেজি ভাষায় যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের এলোমেলো স্মৃতিচারণ করছিলেন। ঘটনাগুলো বলার সময় উনি দারুণ আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন। গল্প শুনতে শুনতে সিঙ্গাপুরে চলে আসি, কিন্তু চাচার কথা ফুরায় না। অতৃপ্তি নিয়ে চাচা নামার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ চাচার হাতগুলো থরথর করে কাঁপছিলো। হাতে থাকা ফাইল থেকে হঠাৎ দুই টুকরো কাগজ নিচে খসে পড়লো।

প্রথমটি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ও অন্যটি মেডিকেল প্রেসক্রিপশন। বুঝতে বাকি নাই আমি এতক্ষণ একজন মুক্তিযোদ্ধার পাশে বসে ছিলাম, আর গত চার ঘণ্টা আমি আমার অস্তিত্বের ইতিহাস শুনছিলাম।

যাওয়ার সময় ভদ্রলোককে চেঁচিয়ে বলতে চেয়েছিলাম, “চাচা, আপনাকে বাংলাদেশের মতোই ভালোবাসি।” কিন্তু ততক্ষণে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনেকদূর চলে গেছেন। কনকনে ঠাণ্ডা ও মনমরা মানুষের এই দেশটাতে এসে বাংলাদেশ ও আপনাদেরকে ভীষণ মিস করছি।

সিঙ্গাপুরে দুই ঘণ্টা ট্রানজিটের জায়গায় বিমান পাঁচ ঘণ্টা দেরি করে। সব মিলিয়ে টানা ৩৬ ঘণ্টার সফর শেষে মধ্যরাতে লন্ডনে এসে পৌঁছাই। কিন্তু মাত্র সাত মিনিটের জন্য স্কটল্যান্ডের সর্বশেষ বাসটি মিস করি। যার খেসারত দিতে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে সারারাত নির্ঘুম বসে থেকে শাস্তি পেতে হয়। পরের দিন সকালে বাস ছাড়ে। লন্ডন থেকে গ্লাসগো ফের ১২ ঘণ্টার সফর। অনেকটা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মতো, যুক্তরাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। ঘুমাতে চেয়েছি, কিন্তু ঘুম আসেনি। স্কটল্যান্ডের উপত্যকা, পাহাড় ও হ্রদ আমাকে ঘুমাতে দেয়নি।

গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টারের মধ্য দিয়ে আমার ইউরোপে উচ্চশিক্ষার নতুন যাত্রা শুরু হলো। ১৪৫১ সালে স্কটল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুরো ইংরেজি বিশ্বের চতুর্থ প্রাচীন বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। গোটা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এক শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এর অবস্থান। আইভি লীগের মতো এটিও রাসেল গ্রুপের অধিভুক্ত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যের প্রথম ও একমাত্র ‘ফাইভ স্টার প্লাস’ বিশ্ববিদ্যালয় এটি, যেখানে ১৪০টি দেশের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এখানে সুযোগ পেয়ে সত্যিই আমার সাহস বহুগুণ বেড়ে গেল।

আমাদের ক্লাস হবে অ্যাডাম স্মিথ বিল্ডিংয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী ও আধুনিক অর্থনীতির জনক স্যার অ্যাডাম স্মিথের নামে ভবনটির নামকরণ করা হয়। তিনি ছিলেন বৃত্তি পাওয়া প্রথম শিক্ষার্থী। বলা হয়ে থাকে, বৃত্তি না পেলে অ্যাডাম স্মিথ পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারতেন না। গবেষণায় স্মিথের অভূতপূর্ব সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি মেধাবীদের বৃত্তি দেওয়া শুরু করে, যার ধারাবাহিকতায় আজকে আমিও বৃত্তি পেলাম।

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মতো আমিও একদিন দেশে ফিরে আসতে চাই। ধন্যবাদ বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!