বার্সেলোনা মানে মেসি, না আরেকটু বেশি!

এবারের হলিডেতে আমরা প্ল্যান করেছিলাম ফুটবলের দেশ, সালসার দেশ, পায়েলা খাবারের দেশ স্পেনের অপূর্ব সুন্দর শহর বার্সেলোনায় যাবো।

জেসমিন রহমান, স্পেন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2017, 09:15 AM
Updated : 8 Sept 2017, 09:44 AM

যদিও ফুটবলপ্রেমিরা বার্সেলোনা মানেই বুঝে বার্সেলোনা ক্লাব ও ফুটবলের জাদুকর মেসি। আমি নিজেও এর বাইরে নই। কিন্তু ভৌগলিকভাবেও বার্সোলোনার অবস্থান অপূর্ব, তাই যারা সাগর ভালোবাসেন তারা গরমের ছুটিতে অবশ্যই বার্সেলোনাকে ভ্রমণ তালিকার উপরের দিকেই রাখবেন।

আমার ছোট দু’ভাই একবার বার্সেলোনা ঘুরে এসেছে। তাদের বর্ণনায় মুগ্ধ হয়ে আমরা এবার যাচ্ছি,

গাইড হিসাবে আমার ছোট দু’ভাই, সঙ্গে আমার তিন ছানাপোনা ও পতি। সব মিলিয়ে আমাদের সাতজন অভিযাত্রীর এই বিচিত্র দল ছুটে চলেছি ফ্রান্সের রোন-আল পেস প্রদেশ থেকে স্পেনের কেতালুনিয়া প্রদেশের দিকে।

কেতালুনিয়া অধিবাসিরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করে আসছে স্পেনের কাছে। এর রাজধানী বার্সেলোনা, ভাষা প্রচলিত আছে বেশ কয়েকটি- কেতালান, অসিতান, এসপাঙল ইত্যাদি। জনসংখ্যা সাত হাজার পাঁচশ’ মিলিয়ন।

সমুদ্র ঘেঁষেই হাইওয়ে, একদিকে পাহাড় আর অপরদিকে ভূমধ্যসাগর। জিওগ্রাফিতে আমরা অসংখ্যবার পড়েছি ভূমধ্যসাগর ভূমধ্যসাগর। কিন্তু কখনও ভাবিনি সেই ভূমধ্যসাগরের পাশেই আমার বসতি হবে আর তার কোল ঘেঁষেই আমি পাড়ি দিবো সুদীর্ঘ পথ। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে কখন যে স্পেন-ফ্রান্সের সীমান্তে চলে এসেছি!

হঠাৎ মনে হলো আমি কেনো ড্রাইভিং সিটে বসে নেই! অনেক সীমাবদ্ধাতার পরও আমি অনেক স্বপ্ন বুনি। বারো গিয়ারের গাড়ি চালাতে চাই, বাড়ির পাশে ছোট একটা ফ্লাইং ক্লাব আছে, ওখানে ভর্তি হতে চাই, আরও কতো কি! এসব কিন্তু স্বপ্ন, কারণ আমিও মাসুদ রানার মতো সেসনা চালাতে চাই।

সেসনা নামটা মনে পড়লেই চোখ চকচক করে উঠে আমার। কিন্তু আজকে তো আমি স্বপ্ন দেখছি না, তাই চট করে বরকে সরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছুটালাম ১৩০ কিমি বেগে। আহা আরও বেশি গতিতে যদি গাড়ি ছোটানো যেতো! একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া জলরাশি, জীবন সুন্দর আর তার চেয়ে বেশি সুন্দর এই বেঁচে থাকা।

অর্পূব এই প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম বার্সেলোনা শহরে। দেখার আরও অনেক কিছু থাকলেও আমি ঠিক করলাম প্রথম দিনই ক্লাব দেখতে যাবো। তাই কোন রকমে হোটেলে চেক ইন করে আমরা চলছি ‘এসটাডি এফসি বার্লেলোনা’ বা বার্সেলোনা স্টেডিয়াম দেখতে। সব সময়ই কিছু দুর্ভাগ্য আমার সঙ্গে লেপটে থাকে, ভাবখানা এমন যে আমাকে ছাড়া তার বেজায় কষ্ট হয়।

তো সেই লেপটে থাকা দুর্ভাগ্যের কারণে ওই সময় কোন ম্যাচ ছিলো না, যা দেখে আমি ও আমার সহযাত্রীরা নিজেদের ধন্য মনে করতাম। ম্যাচ না থাকলে কি হবে, দর্শণার্থীর কিন্তু অভাব নেই। এখানে একটা ফটো ওইখানে একটা ফটো এই করছে সবাই। আমরাও তার বাইরে নই।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম- আরে ওই তো শাকিরার বয়ফ্রেন্ড! পিকে সাহেব, জেরার্ড পিকে! বেশির ভাগ স্প্যানিশ যুবকের চেহারা অনেকটা জেরার্ড পিকে টাইপের বলেই আমার মনে হয়েছে। একজনকে আবার মেসির মতোও লেগেছে। এর কারণ অবশ্য আছে, ওই একটা ব্যাপার আছে না, প্রথম প্রথম প্রেম! প্রেমিকার এতো বড় দাঁতকে মনে হয় মুক্তার মতো আর প্রেমিকের ট্রাকের চাকার মতো ঠোঁটকে মনে হয় আহা পুরুষ! আমারও সেই রকম অবস্থা, যাকে দেখি তাকেই বার্সেলোনার খেলোয়াড় বলে ভ্রম হচ্ছে।

এদিকে পেট মোচড় দিয়ে জানান দিচ্ছে, ওই আর কতো খালি মাঠ চক্কর দিবি, আমারেও একটু দেখরে মা! অতঃপর খাবারের খোঁজে। বিশাল সব শপিং মল আছে এখানে। আমি মনে মনে খুব বড় না হলেও মাঝারি মানের একটা শপিং করার চিন্তা করেছি। পরিচিত অনেকেই বলেছেন স্পেনে সব কিছুর অনেক কম দাম, যদিও আমার তেমন পার্থক্য মনে হয়নি। আপনারা যারা আসবেন অবশ্যই শপিং করবেন, অন্তত কিছু স্যুভিনর তো কিনতেই হবে স্মৃতি রাখার জন্য।

দ্বিতীয় দিন আমি ঠিক করলাম (আমি বলছি কারণ এই দলে আমিই বস) দেখতে যাবো ‘লাকুয়ারি আমবার্সেলোনা’। আমার বাচ্চাদের এটা খুবই পছন্দের জায়গা। আপনাদের বাচ্চাদের নিয়েও অবশ্যই এখানে আসবেন। এখানে আছে শার্ক, শার্ক এগ, পেঙ্গুইন, ক্লাউনফিস নিমো আর ব্লু ট্যাংগ ডরি, সি হর্স, জেলি ফিস, ইলেট্রিক রে, ডামসেল ফিস, ডগফিস, রেড স্টারফিসসহ চারশ’ পঞ্চাশ প্রজাতির প্রায় এগারো হাজার প্রাণী ও প্রবাল।

আর যেটা সবচেয়ে চমকপ্রদ সেটা হলো আশি মিটার সাব অ্যাকুয়াটিক টানেল যা আপনাদের ভূমধ্যসাগর ও ক্রান্তীয় সমুদ্রের তলদেশ ভ্রমণের আনন্দ দেবে। চারদিকে হাঙ্গরের ঘুরোঘুরি, বিষাক্ত ও রঙ্গিন মাছ! গায়ে চিমটি কাটি, কল্পনা না বাস্তব! আরেকটি মজার ব্যাপার আছে এখানে,

অ্যাকুরিয়ামে ঢোকার পথেই আছেন প্রায় সব দেশের ভাষা জানা একজন সুদর্শন ক্যামেরাম্যান ও তার সহকারি, যারা আপনাদের দারুণ একটা গ্রুপ ফটো বা ফ্যামিলি ফটো তুলে দেবেন।

ছবিতে আপনার সামনে থাকবে একটা শার্ক ও পেছনে ওই টানেলটি, এটা অবশ্যই মিস করবেন না, যেমন আমি করিনি। বর্তমান আমাদের গ্রুপ ছবিটি শোভা পাচ্ছে আমার লিভিংরুমে এবং বাসায় কেউ আসলেই আমি চোখ চকচক করে বলছি- ‘ও এই ছবিটার কথা বলছেন? ওটাতো বার্সেলোনার অ্যাকুরিয়ামে তোলা বুঝছেন, দারুণ জায়গারে ভাই!’

এরপর গন্তব্য ‘মবজুস ক্যাবল কার’, এর যাত্রা ১৯৭০ সাল থেকে। উচ্চাতায় দুই হাজার চারশ’ ৬৭ ফিট ও লম্বায় সাতশ’ ৫২ মিটার। ক্যাবল কারের তিনটা স্টেশন আছে। আপনি চাইলে প্রতিটি স্টেশনে নামতে পারেন, খানিকটা সময় নিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এটা এমনই অপূর্ব একটা জায়গা যেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি কীভাবে ভালোবেসে আকাশটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে তা দেখা যায়। দিগন্ত বলে কিছু যে আছে, আমার তেমন মনেই হয়নি।

আমার কেবলি মনে হচ্ছিলো, সাগর নেই পুরাটাই আকাশ। পর্যটকরা শুধুই মুগ্ধ হয়ে দেখছে, কোন কথা হচ্ছে না এখানে। কথা না বলে বরং চিৎকার বলা যেতে পারে। কথা যা বলার তা আমিই বলেছি আমার বিচ্ছুবাহিনীর সঙ্গে। এখানে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আপনি প্রচুর ভিউ পাবেন ছবি তোলার জন্য। তাই অবশ্যই অনেক ছবি তুলুন। আপনার সঙ্গীর হাত ধরে কিছুটা সময় চুপ করে বসে থাকুন আর দেখতে থাকুন এই অসীম নীলকে। আর ভাবতে থাকুন একটা মেঘের ভেলা যদি ভাড়া পাওয়া যেতো, তবে বেশ হতো!

বাস্তবতা হলো মেঘের ভেলা ভাড়া পাওয়া না গেলেও হেলিকপ্টার ও বোট ভাড়া পাওয়া খুবই সহজ। অবশ্য তার জন্য কেবল কারে করে আবার শহরে ফিরতে হবে। ও হ্যাঁ, এখানে আসার পথে আমরা দেখেছি ক্রিস্টোফার কলম্বাসের বিশাল এক প্রতিকৃতি। আমি অবশ্য খুব কাছ থেকে দেখতে পারিনি সময়ের অভাবে। কিন্তু আপনারা অবশ্যই সময় নিয়ে কাছ থেকে দেখবেন।

এতো নীল জলরাশি, আর তাতে যদি ঝাঁপিয়ে না পড়ি তবে কীভাবে হবে? তাই সবাই মিলে চলছি সমুদ্রস্নানে। সৈকতে প্রচুর টুরিস্ট থাকলেও আমরা ঠিক পানির কাছাকাছি একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। সমুদ্রের পানিতে দাপিয়ে বেড়াতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয় বাচ্চারা। আর তাই বাচ্চাদের জন্য পর্যাপ্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থাও কিন্তু থাকতে হবে। পানি ঠাণ্ডা, প্রচুর বাতাস ও সাথে বড় বড় ঢেউ ছিলো, আর ছিলো সুদর্শন বে-ওয়াচ। আমার সঙ্গী-সাথীরা যখন সমুদ্রে  ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আমার ছোট কন্যা যখন বালি দিয়ে খেলে সারা শরীর বালিময়, তখন আমি বসে বসে দেখছি সুদশর্ন বে-ওয়াচদের ।

‘লা সাগ্রাদা ফামিলা’ একটি অপূর্ব রোমান ক্যাথলিক চার্চ। এর নির্মাণ কাজ এখনও চলছে, শুরু হয়েছিলো ১৮৮২ সালে এবং শেষ হবে সম্ভাব্য ২০২৬-২০২৮ সালে। অপূর্ব নির্মাণশৈলীর জন্য স্পেনে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এটি। এর নকশা করেছিলেন কাতালান প্রকৌশলী অ্যান্থনি গাউদি (১৮৫২-১৯২৬)। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে গাউদির মৃত্যুর প্রায় একশ’ বছর পরে এর সম্ভাব্য নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে ভাবা হচ্ছে। তাই  অবশ্যই দেখতে ভুলবেন না ‘লা সাগ্রাদা ফামিলা’ ও সঙ্গে অসাধারণ কিছু ছবি।

বিখ্যাত স্প্যানিশ খাবার পায়েলা অবশ্যই খেতে হবে, না খেলেই মিস করা হবে। যেমন আমরা কখনও মিস করতে চাইতাম না পুরাতন ঢাকার তেহেরিকে। আমরা যদিও পায়েলাকে স্প্যানিশ ডিশ বলে থাকি কিন্তু স্প্যানিশরা পায়েলাকে ভ্যালেনসিয়ার আঞ্চলিক খাবার মনে করে। এখানে বিভিন্ন ধরনের পায়েলা পাওয়া যায়। যেমন- ভ্যালেনসিয়ান পায়েলা, সি ফুড পায়েলা ও ভেজিটেবল পায়েলা। আমরা যেটা খেলাম সেটা ছিলো সি ফুড পায়েলা, খুবই সুস্বাদু, বিশেষ করে অক্টোপাসের শুরগুলো!

লা রামব্লাসের কথা না বললেই নয়। বার্সেলোনার খুবই ব্যস্ত একটা সড়ক এবং টুরিস্টদের কাছেও জনপ্রিয় বটে। আছে প্রচুর খাবারের দোকান। কেউ খাচ্ছে তো কেউ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ সেলফি তুলছে তো কেউ শুধুই হেসেই যাচ্ছে। আমরাও খাবারের খোঁজে এই রাস্তা ধরে কয়েকবার যাওয়া-আসা করেছি। আরও অনেক দর্শনীয় জায়গা থাকলেও সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে যাওয়া হয়নি এই যাত্রায়। আবার আসবো বলে মনকে কথা দিয়ে সুন্দরী বার্সেলোনাকে বললাম- ‘আদিওস বার্সেলোনা’!

ফিরে চলছি নিজের সেই পরিচিত লোকালয়ে, নিজের ডেরায়। বর হঠাৎ বলেলেন- ‘কী ভাবছেন বেগম?’ আমি উদাস মুখে বললাম- ‘ভাবছি এত্তো সুন্দর আমাদের এই নক্ষত্রটাকে দেখতে হলে আর একটু বেশি পরিমানে টাকা-পয়সা থাকা বড়ই দরকার।’ বর বললেন- ‘মানে কি?’ আমি বললাম- ‘মানে হলো পরের হলিডেতে আমরা যাবো ভূমধ্যসাগরের বুকে ফ্রান্সের অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ লা কোর্সে।’

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!