সহিদুল আমার কথায় রাজি হয়ে সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার প্রয়োজন মনে করিনি। যেহেতু আবার ফিরে আসব রাতে। তবে গাড়ি পার্কিং-এ গিয়ে দেখি, খন্দকার রুমী আর রাসেল রহমান চৌধুরী ভাই তাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
আগের রাতে রুমী আমার হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “নিজাম ভাই আপনাদের খরচ দিয়েছেন।” আমি নিতে না চাইলেও রুমী বাধ্য করেছিল সেই খরচ নিতে। তাই বিষয়টি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, তাকে আমার ধন্যবাদ পৌঁছে দিতে।
রাসেল ভাই বললেন, “ভাই, যান কই? দুপুরে যে চিকেন বিরিয়ানী রান্না হবে। না খেলে যে কষ্ট পাবো।” আমি বললাম, “আমাদের জন্য রেখে দিয়েন, আমরা বিকালে এসে খাবো তাহলে।” বলেই ফোন দিলাম আমাদের হোস্ট নিজাম উদ্দিন ভাইকে। ওনার ফোন বন্ধ পেলাম।
গাড়িতে বসেই ফেইসবুক চালু করতেই দেখি, আমার পরিচিত এক ভাইও স্বর্ণ মন্দিরে যাচ্ছেন। থাকে সে কানাগাওয়া প্রিফেকচারে। কিছুদিন আগেই তার সাথে পরিচয় হলো। বিয়ে করেছে জাপানি এক নারীকে। তার জাপানিজ নাম ‘মিস কানা’ আর বাংলা নাম ‘ফাতেমা হোসেইন’।
ভাবলাম, ভালোই হলো, সেখানেও বাঙালির দেখা পাবো। দেখা হলে সহিদুল তো আরও বেশি অবাক হবেন। তাকে অবাক করার জন্যই বিষয়টি গোপন রেখে ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করে জানিয়ে দিলাম, আমিও ওখানে আসছি।
এখন থেকে প্রায় দশ বছর আগে আমি কিয়োটো স্বর্ণ মন্দিরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একবার এসেছিলাম নিজাম উদ্দিন ভাইয়ের ঠিকানায় কোনো এক ঈদ আয়োজন ইউস্ট্রিমের মাধ্যমে লাইভ করার জন্য। ইউস্ট্রিমে তখন ‘বিবেক টিভি’ নামে জাপানের বিভিন্ন প্রিফেকচারে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতাম আমি। টিভি চ্যানেলটি আমি বন্ধ করে দেই অনেকটাই কমিউনিটির লোকদের উপর রাগ, দুঃখ আর অভিমান করে।
যাহোক, বলছিলাম এই কিয়োটো শহরে আসা প্রসঙ্গে। তখন এই নিজাম উদ্দিন ভাই-ই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন স্বর্ণ মন্দিরসহ আরও কিছু এলাকায়। আমার ছেলে থাইও-ও ছিল। ছিলো আরও একজন সাংবাদিক বন্ধু। ফলে আমাদের এবারের যাত্রায় আগের মতো রোমাঞ্চ কাজ করছে না।
কিয়োটো জাপানের পুরনো রাজধানী। এবার বাসা থেকে আসার সময় তিনদিনের প্রস্তুতি নিয়ে বের হলেও মোবাইলের চার্জার নিয়ে আসা হয়নি। রাতে অন্যের চার্জার দিয়ে মোবাইল চার্জ দিলেও এরই মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো চার্জ। যেটুকু ছিলো, সেটা থামিয়ে রাখলাম স্বর্ণ মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে কবির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
ভাবলাম, আমাদের ছাড়াই ভেতরে ঢুকে গেলো? ফোন দিলাম কবিরকে। বললেন, ওরা আশেপাশেই আছে। মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে যেন ফোন কল দেই। আমাদের আসতে কিছুটা দেরি হবার কারণ ছিল, কাছাকাছি পার্কিং খালি পাচ্ছিলাম না। পার্কিং খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গাতে খালি পেয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম সেখানে।
গাড়ি পার্কিং করে কিছুদূর হেঁটে স্বর্ণ মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি পর্যটকদের ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলে ফেইসবুকে লাইভ গেলাম। দেখলাম অনেকেই আমার সাথে লাইভে এসে গেইটে লোকের ভিড় দেখছে। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম আশেপাশের দৃশ্য। কেউ কেউ মন্তব্য লিখে পাঠাচ্ছিলেন।
সহিদুল হককে জাপানিজ মুদ্রার এক হাজার ইয়েনের একটা সবুজ নোট ধরিয়ে দিয়ে টিকিট কাটতে বললাম। সামনে গিয়ে টিকিট কিনে নিয়ে এলে সেটাসহ আবার ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। ভিড়ের মাঝে ছবি তোলার সময়-সুযোগ করা মুসকিল। ভিড়ের মাঝে পটাপট দুই তিনটা ছবি তুলে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
সময়টি যেহেতু জাপানে সরকারী ছুটির দিন, তাই লোকের ভিড় অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু অবাক হবার মত বিষয় হলো, এখানে দর্শনার্থীদের মধ্যে চাইনিজদের সংখ্যাই যেন শতকরা পঁচানব্বই জন! ওদের ‘চেংপেং’ কথা শুনে মনে হয়, ওরা যেন ঝগড়া করছে।
ফোনে কবির হোসেন বললেন, গেইটের কাছে কোনো এক রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করছে ওরা। বললাম, আমি ভেতরে ঢুকছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে এসে আবার কল দেব। বলেই ভেতরে ঢুকে গেলাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো স্বর্ণ মন্দির। চক চক করছে।
স্বর্ণ মন্দিরটি প্রথম ১৩৯৭ সনে সম্রাট আশিকাগা ইয়োশিমিৎস্যু নির্মাণ করেন। এটি জাপানের বিশ্ব ঐতিহ্য ও জাপানের আকর্ষণীয় স্থাপত্যগুলোর একটি। মন্দিরটি তিন তলা বিশিষ্ট হলেও উপরের দুটি তলার পুরোটাই স্বর্ণপাত দিয়ে মোড়ানো। ১৪৬৭-১৪৭৭ সালের মধ্যে ‘ওনিন যুদ্ধ’ চলাকালে এই মন্দির সম্পূর্ণ আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর আবার নির্মাণ করা হয় এটি।
কিন্তু ১৯৫০ সালের ২ জুলাই, ২২ বছর বয়সী এক বৌদ্ধ মং এখানে আত্মবলী দেবার উদ্দেশ্যে মন্দিরটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন এটি পুরো ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ১৯৫৫ সালে। এটিকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘কিনকাগুজি’। আনুষ্ঠানিক নাম ‘রকুওন-জি’। সাহিত্যিক ভাষায় ‘ডিয়ার গার্ডেন টেম্পল’।
বাইরে কবির হোসেন আর তার জাপানি স্ত্রী অপেক্ষা করছিলো। তাই জলদি বের হয়ে তাদের সাথে দেখা করলাম। কাছেই পাহাড়ের উপর লেখা জাপানিজ অক্ষরে লেখা ছিলো ‘দাই’, মানে ‘বড়’। সেটাকে ফ্রেমে ফেলে আমরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। ছবি তুলে কিছু সময় কবিরের সাথে কথা বলে ওদের বিদায় দিয়ে আমরা চলে গেলাম কাছেই রৌপ্য মন্দিরের কাছে। সেখানেও গাড়ি পার্কিং সমস্যা। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় পেলাম খালি পার্কিং। সাথে সাথে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম গাড়ি।
গাড়ি রেখে হাঁটতে থাকি রৌপ্য মন্দিরের দিকে। ক্ষুধা তখন চরমে পৌঁছে গেলো আমার। সেখানে খেতে বসলে পার্কিং-এর বিল বেড়ে যাবে মনে করে কিছুটা ধৈর্য ধরলাম। ভেতরে যাবার জন্য এখানেও আবার টিকিট কাটতে হবে। তাও জন প্রতি পাঁচশ’ ইয়েন। দু’জনে বলাবলি করছিলাম, এখানে দেখছি সোনার চেয়ে রূপার দাম বেশি।
জাপানের প্রতিটি মন্দির দেখতে প্রায় একইরকম। পানি, বাগান, গাছপালা, পানিতে মাছ, পাড় ঘেঁষে বড় পাথর আর পাহাড়ি এলাকা হলে পাহাড়ে ওঠার পথ। রৌপ্য মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আবার ফেইসবুক লাইভে গেলাম। এবার আর নিজের আইডি থেকে নয়। বরিশাল থেকে সাংবাদিক নোমানী মামুনের অনুরোধে তাদের গ্রুপে ঢুকে লাইভ করলাম। তাদের গ্রুপের নাম ‘ফ্রেন্ডস ফর লাইফ’।
রৌপ্য মন্দিরের জাপানিজ নাম ‘গিনকাগু-জি’। আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ‘জিশো-জি’। ১৪৯০ সালে এটি নির্মিত। ‘আশিকাগা ইয়োশিমাছা’ স্বর্ণ মন্দিরের আদলে দ্বিতল বিশিষ্ট এই মন্দিটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। রৌপ্য পাত দিয়ে মোড়ানো বলে রৌপ্য মন্দির বলা হয় একে। মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অফিস থেকে চেয়ে নিলাম।
একদিনে এই কিয়োটো শহর ঘুরে দেখে শেষ করা যাবে না। মনে পড়লো, ফিরে যাবার কথা। রাসেল ভাইকে দিয়ে আসা কথা অনুযায়ী চিকেন বিরিয়ানী খেতে ফিরে যেতে হবে। তাই বেশি দেরি করা যাবে না।
অল্প সময়ের মধ্যে দেখার ইচ্ছে হলো সামনেই পুরোনো এক ক্যাসেল। এটি এখানকার বিখ্যাত ও দর্শনীয় একটি স্থাপত্য। ১৯৬৪ সালে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্যটি। মূলত দর্শনার্থীদের জন্যই এটি অনেকটা ‘ক্যাসেল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক’ হিসাবে তৈরি করা হয়। এর আগে মূল যে ক্যাসেলটি ছিলো, সেটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৫৯২-১৫৯৪ সনের মধ্যে এবং তয়োতমি হিদেইয়োশির জন্য।
তয়োতমি হিদেইয়োশি ছিলেন শক্তিধর সেনাপতি। নির্মাণের দুই বছর পর বড় রকমের এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায় এটি। এরপর আবার নির্মাণ করা হয় ১৬০০ সালে, এটিও আগুনে ধ্বংস হয়ে গেলে পরবর্তীতে এখন যেটি আছে সেটি রেপ্লিকা হিসেবে নির্মাণ করা হয় পাথরের উপর পাথর বসিয়ে। ক্যাসেলটি ‘ফুশিমি ক্যাসেল’ নামেই বিখ্যাত। ২০০৩ সালে এটি সর্ব সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলেও পুনরায় উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সহিদুলকে বললাম, “আগে চলেন কোথাও বসে কিছু খেয়ে নেই। যেখানে বসবো সেখানে যেনো মোবাইল চার্জ দেওয়া যায়। আর এখানকার বিশেষ কোনো খাবার থাকলে তা খেতে হবে।”
ক্লান্তির কারণে ঘুম পেয়েছিলো, কিন্তু ঘুমানো যাবে না। কেউ এসে যদি আবার পাশ থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে যায়! সহিদুল গাড়িতে বসে একটা ঘুম দিলেন। আমি দোকানের ভেতর বসে খাবার খেয়ে ল্যাপটপে কাজ করছি। কাছেই পুরনো সেই ক্যাসেল। সেটা দেখার জন্য টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। কয়টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে, তা জানা নেই।
হেঁটে চলে গেলাম ক্যাসেলের গেইটে। টিকেট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়াতেই আমাদের সামনে লম্বা ফিতা টেনে বলল, “ইমা ওয়ারি দেস।” মানে- এখন শেষ। আবার ৭টার সময় খোলা হবে। মনে মনে নিজেদের উপরই রাগ হলো। কয়েক মিনিট কম বিশ্রাম নিয়ে আসলেই টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে পারতাম।
বাইরে কিছু সময় ঘুরে, ছবি তুলে, ভিডিও করে চলে গেলাম গাড়িতে। যাবার সময় ক্যাসেলের পাশে চারিদিক ঘেরা পানিতে দেখলাম, বড় বড় বক মাছ ধরার জন্য ওৎ পেতে বসে আছে। বক দেখে ছাত্র জীবনে এয়ারগান নিয়ে বিলে বক শিকারের কথা মনে পড়লো।
গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলাম মূল শহরে। সেখানে যতটা সম্ভব ঘুরে দেখে রওনা দিলাম রাসেল ভাইদের ক্যাম্প। তাদের রান্না করা চিকেন বিরিয়ানী যে খেতে হবে।
লেখক: জাপান প্রবাসী
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |