প্রবাসীর চোখ: সড়ক ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ কোরিয়া

এখন পত্রিকা খুললেই সবার চোখে একটাই খবর- বন্যা কবলিত মানুষের দুর্দশা। আমাদের সবার জন্য খুবই দুঃখের বিষয় এটি।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2017, 04:54 AM
Updated : 22 August 2017, 04:55 AM

তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, দেশের মানুষের সাথে প্রবাসীরাও তাদের সাধ্যমত সাহায্য করছে বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

সারা দেশের বন্যার ছবি আর খবর দিয়ে ফেইসবুক ভরা। সাথে দেখলাম ঢাকা শহরের বন্যার দৃশ্য। দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে এটুকু বলতে পারি যে ঢাকার অবস্থার জন্য আমরাও বেশ খানিকটা দায়ী। আজ যদি আমরা সঠিক জায়গায় ময়লা ফেলতাম, সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চলতাম, তাহলে এই দুর্দশা অনেকটাই কমে যেত।

কেন বললাম সেটা বলছি। কোরিয়াতে আপনি চাইলেই ইচ্ছামতো যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলতে পারবেন না। রাস্তায় ময়লা ফেলা নিষেধ। ময়লা ফেলার জন্য আছে নির্দিষ্ট ব্যাগ। শুকনো ময়লা এবং ভেজা ময়লা ফেলার আলাদা আলাদা নিয়ম।

আপনি ইচ্ছামতো ময়লা ফেলবেন? পারবেন না। প্রত্যেকটা জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো আছে। এখন যদি মনে করেন, আরে ধুর কে দেখবে? উহু... এই সামান্য ময়লা যেখানে সেখানে ফেলার জন্য আপনাকে গুণতে হবে বিশাল অঙ্কের জরিমানা। এটাই সত্যি।

এটুকু নিয়মের জন্যই বিদেশ এতো পরিষ্কার-পরিছন্ন। যার দরুণ পোহাতে হচ্ছে না জলাবদ্ধতার মতো ঝামেলা। দেশের মতো এখানেও মুষলধারে বৃষ্টি হয়, কিন্তু তাতে  কোন সমস্যা হয় না।

একটু খানি নিয়ম যদি মেনে চলি, তাহলেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমরা তো দেশে গিয়ে অবশ্যই এইসব নিয়ম মেনে চলবই। এখানে যদি নিয়ম মানতে পারি, তাহলে দেশে কেন মানতে পারব না?

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাস্তাঘাটের নিয়ম মেনে চলা। কোরিয়ানরা এই দুটো নিয়ম অবশ্যই মেনে চলে। এক- ময়লা ফেলা, আর দুই- সড়কের নিয়মানুব্যবস্থা। কয়েক মাস আগে পত্রিকাতে দেখেছিলাম দেশে আঠারো বছরের নিচের ছেলেদের গাড়ি চালানো নিয়ে প্রতিবেদন। এদের আসলে কোন কঠোর দেশে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। তখন চাপে পড়ে ঠিকই সব মেনে চলবে।

দক্ষিণ কোরিয়ার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হচ্ছে অনেক কিছু। প্রথমেই বলতে হয়, কোনোভাবেই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবেন না। আর বয়স অবশ্যই আঠারো হতে হবে। তাহলেই আপনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ পেলেই তখন লাইসেন্স পাবেন।

কিন্তু কোরিয়াতে শুধু লাইসেন্স পেলেই হবে না, সাথে নিয়মগুলোও মেনে গাড়ি চালাতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় আপনি চাইলেই যখন তখন লেইন পাল্টাতে পারবেন না। লেইন ধরে গাড়ি চালানোটা খুব বেশি গুরুত্ব পায়।

আর কোরিয়াতে স্টেরিয়ারিং হাতের বাম পাশে। তো আমাদের জন্য প্রথম প্রথম গাড়ি চালানোতে খুব সতর্ক থাকতে হয়েছে। আমার মনে হয় কোরিয়াতে শহরের ভেতর গাড়ি চালানো থেকে হাইওয়েতে গাড়ি চালানো খুব সহজ।

শহরের ভেতর একটু বেশি ভীড়, একটু জ্যাম। এর থেকে হাইওয়েতে অনেক ফাঁকা থাকে রাস্তা। এতো বড় রাস্তা, চারটা লেইনসহ। মানে দুই দিক মিলিয়ে আটটা লেইন। যেহেতু এখানে লেইন মেনে চলে সবাই, এজন্য জ্যামও কম সাথে দুর্ঘটনাও কম।

শহরের ভেতরের পাবলিক সার্ভিস বাসগুলোর জন্য আলাদা লেইন দেখেছি সব জায়গায়। অসম্ভব শৃংখলাবদ্ধ। প্রত্যেকটা বাস সময় মেনে চলে। এর জন্য আপনাকে অফিস যাওয়ার জন্য দুই ঘণ্টা আগে বের হতে হবে না। একটু পর পরই বাস স্টপেজ পাচ্ছেন।

কিছুদিন আগেই আমাদের কোরিয়ান সরকারকে বেশ কিছু জরিমানা দিতে হয়েছে। কেন? স্পিড লিমিট না মেনে চলায়। যদিও আমরা বুঝতেই পারিনি যে কখন এটা হয়েছে। বাসায় যখন জরিমানার জন্য চিঠি আসলো তখন বুঝলাম। শুধু চিঠি না, সাথে প্রমাণও। যে রাস্তাতে হয়েছে, ওই রাস্তায় গাড়ির ছবিসহ স্পিড লিমিট দেওয়া।

ভাবা যায়, দেশে কেউ স্পিড লিমিটের জন্য জরিমানা দিয়েছে? আমরা দিয়েছি। খুব সম্ভবত ওই রাস্তায় স্পিড লিমিট ছিল ৬০। আর আমাদের মনে হয় ছিল ৬৫। যার জন্য আমাদের কোরিয়ান সরকারকে ৩০ ডলার দিতে হয়েছে। এর থেকেই বুঝতে পারছেন যে এখানে স্পিড লিমিট মেনে চলাটা কতোটা জরুরী।

আমরা অবশ্য এইগুলা খুব মূল্য দেই। নিয়ম-কানুন মেনে চলছে দেখেই ওরা এতো উন্নতি করতে পারছে খুব সহজেই। আর ওরাই বা কেন মানবে না। ওদের সুবিধার জন্যই এতো কিছু।

প্রত্যেকটা শহর থেকে শুধু এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য এক্সপ্রেস বাস আছে। একদম সরাসরি এয়ারপোর্ট যাবে। তাও সময়মত পৌঁছাবে। কেননা এইসব এক্সপ্রেস বাসের জন্য আলাদা লেইনই করেছে ওরা। আশ্চর্য হওয়ার মতো, তাই না?

দেশে আমি নিজেই অনেক বার দেখেছি, জ্যামে বসে আছি ঘণ্টার পর ঘন্টা। শুধু সাধারণ জনগণ না, সাথে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগী। কিন্তু এই রকম ঘটনা এখানে চিন্তাই করা যায় না। আপনি যত জ্যামেই থাকেন না কেন, কোরিয়ানরা যদি ইমারজেন্সি শব্দ শোনে, তাহলে অবশ্যই নিজে থেকে সবাই ওই গাড়ি যাওয়ার জন্য রাস্তা বের করে দেবে। এটাকে কী বলা যায়? নিয়ম নাকি মানবিকতা?

এরকম অনেক ছোট ছোট বিষয় আছে, যার অল্প কিছু মেনে চললেও অনেক ভাল কিছু হবে আমাদের। যেমন- শব্দ দূষণ। কোরিয়াতে কেউ ইমারজেন্সি ছাড়া গাড়ির হর্ন বাজায় না। কেউ যদি হর্ন বাজিয়ে ফেলে, তখন রাস্তার সবাই তার দিকেই তাকিয়ে থাকে হা করে- কেন হর্ন দিলো? অসম্ভব মনে হচ্ছে, তাই না? এমনই এখানে। এখন তো আমার মেয়ে যদি কখনও হর্ন শোনে, তাহলেই দুই কান চেপে ধরে থাকে।  

এখন মনে হতে পারে, এরকম অনেক নিয়ম তো আমাদের দেশেও আছে। পার্থক্যটা কোথায়? কিন্তু এটার উত্তর খুব সহজ। নিয়ম মানবেন কি মানবেন না, ওইটা একদমই আপনার উপর, তাই না? একটু করেও যদি আমরা কিছুটা নিয়ম মেনে চলি, তাহলে ওই জলাবদ্ধতার বন্যা আর ওই অনেক দুর্ঘটনাও অনেক কমে আসতো।

প্রশ্ন এখানে আরও একটা হতে পারে। আমরা যারা প্রবাসী, তারা কিন্তু এখানকার সব নিয়মই মেনে চলছি। কিন্তু দেশে গিয়ে কি দেশের এই ছোট ছোট জিনিসগুলো মেনে চলছি? হ্যাঁ, আমি আর আমার পরিবার পরবর্তীতে যখনই দেশে যাব, অবশ্যই এই অভ্যাসগুলো মেনে চলবো।  

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন